নিউটার্ন ডেস্ক :
বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের তিন দিন পর নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে।
নতুন এই সরকারে ১৭ জন উপদেষ্টা রয়েছেন, যাদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুইজন সমন্বয়কের নামও দেখা যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার রাত নয়টার পরে বঙ্গভবনে নতুন সরকারের উপদেষ্টারা শপথ নেন। সেখানে তাদেরকে শপথ বাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নাম আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন তিনি ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থান করছিলেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি দেশে ফেরার পর তার সঙ্গে বৈঠক করে বৃহস্পতিবার উপদেষ্টামণ্ডলীর বাকি সদস্যদের নাম প্রকাশ করা হয়।
এ তালিকায় যারা রয়েছেন, তাদের মধ্যে আছেন – বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল, মানবাধিকার কর্মি আদিলুর রহমান খান, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন।
এ তালিকায় আরও রয়েছেন – বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার এবং ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুর্শিদ।
এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে দুইজন উপদেষ্টাদের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন – নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া।
এর বাইরে শপথ গ্রহণের জন্য আরও ডাক পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর জাহান বেগম, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ডা. বিধান রঞ্জন রায় এবং হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক নায়েবে আমীর আ ফ ম খালিদ হোসেন।
কার কী পরিচয়?
নতুন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি ২০০৫ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন।
উপদেষ্টাদের তালিকায় নাম রয়েছে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন।
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষক, গবেষক ও কলামিস্ট হিসেবেও সাখাওয়াত হোসেনের পরিচিতি রয়েছে।
উপদেষ্টা হিসেবে ডাক পেয়েছেন অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবেও তিনি পরিচিত।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন সময় অধ্যাপক নজরুলকে বেশ সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে।
এমনকি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা সরে যাওয়ার পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের সমদস্যদের ডেকে সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান যে বৈঠকটি করেছিলেন, সেখানেও তাকে রাখা হয়েছিল।
উপদেষ্টার তালিকায় নাম রয়েছে মানবাধিকারকর্মি আদিলুর রহমান খানের। তিনি মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
আদিলুর রহমান খানকে ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মিদের সরিয়ে দেয়ার অভিযানে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে ‘বিভ্রান্তি ছড়ানোর’ অভিযোগে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল।
পরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারার মামলায় তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। তবে আদিলুর রহমান খান এখন জামিনে মুক্ত আছেন।
উপদেষ্টা হয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার প্রধান নির্বাহী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বেশ সরব। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন সময় হামলারও শিকার হয়েছেন।
পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ২০১২ সালে ‘রামোন ম্যাগসেসে’ পুরস্কার পান করেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
এছাড়াও ‘গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজ’, টাইম ম্যাগাজিনের ‘হিরোজ অব এনভায়রনমেন্ট’ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন রিজওয়ানা হাসান।
উপদেষ্টার তালিকায় নাম রয়েছে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেনের। অতীতে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট হিসেবেও তৌহিদ হোসেনের পরিচিতি রয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে উপদেষ্টামণ্ডলীর তালিকায় নাম রয়েছে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ। তারা দু’জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। গত জুনে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই তারা এটির নেতৃত্বে ছিলেন।
একপর্যায়ে আন্দোলন সারা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে জুলাই মাসের শেষের দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তাদেরকে তুলে নেয়া হয়েছিল।
এরপর দু’জনকে যখন খুঁজে পাওয়া যায়, তখন তাদের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। শেখ হাসিনা পদত্যাগের কিছুদিন আগে নিরাপত্তা দেয়ার অজুহাতে তাদেরকে আবারও তুলে নিয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে তারা রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধানসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও মহলের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক ইউনূসের নাম প্রস্তাব করার পাশাপাশি তার সঙ্গে যোগাযোগ করে রাজি করানোর ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন দুই সমন্বয়ক।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে তালিকায় জায়গা পেয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা। তিনি ২০২৩ সালে ২৪ জুলাই ওই দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এর আগে, সুপ্রদীপ চাকমা মেক্সিকো এবং ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
উপদেষ্টার তালিকায় নাম রয়েছে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ।
এর আগে, তিনি ২০০৭ সালে ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ছিলেন।
তারও আগে ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন এ এফ হাসান আরিফ।
এছাড়া নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুর্শিদ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হয়েছেন। ভোটাধিকার ও বাক-স্বাধীনতার বিষয়ে তিনি বেশ আগে থেকেই সরব। এছাড়া তিনি নির্বাচন ব্যবস্থা বিষয়ক বিশ্লেষক হিসেবেও পরিচিত।
এর বাইরে, উন্নয়ন ও মানবাধিকারকর্মি ফরিদা আখতার উপদেষ্টা হয়েছেন। তিনি বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা’র (উবিনীগ) নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।-বিবিসি
তিনি মানবাধিকার, বিকল্প কৃষি উৎপাদন ও গবেষণা এবং নারী অধিকার বিষয়ক একজন কর্মি। তার স্বামী ফরহাদ মজহার বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য লেখক ও কলামিস্ট।
আরও উপদেষ্টা হয়েছেন সাবেক নৌ কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ‘অপারেশন জ্যাকপট’ অভিযানের উপ-অধিনায়ক ছিলেন বলে জানা গেছে।