Home » আন্তর্জাতিক » আলোচনার জন্য ‘পুরোপুরি প্রস্তুত’ থাকলেও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সংশোধন চায় হামাস

আলোচনার জন্য ‘পুরোপুরি প্রস্তুত’ থাকলেও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সংশোধন চায় হামাস

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
Author,রুশদি আবু আলৌফ
Role,গাজার সংবাদদাতা

গাজায় নতুন যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তি চুক্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ প্রস্তাবের বিষয়ে মধ্যস্থতাকারীদের কাছে “ইতিবাচক সাড়া” দিয়েছে হামাস।বিবিসি

ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে তারা “অবিলম্বে আলোচনায় অংশ নিতে পুরোপুরি প্রস্তুত”।

আলোচনার বিষয়ে অবগত একজন জ্যেষ্ঠ ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, হামাস আলোচনা প্রস্তাবের সাধারণ কাঠামো মেনে নিলেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন চেয়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি গ্যারান্টি চেয়েছে যে ২০ মাসের যুদ্ধ স্থায়ীভাবে শেষ করতে আলোচনা ব্যর্থ হলেও যুদ্ধ আবার শুরু হবে না।

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে এর আগে তারা এই ধরনের দাবি মানতে অনাগ্রহ দেখিয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার বলেন, ইসরায়েল ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির জন্য “প্রয়োজনীয় শর্তাবলি” মেনে নিয়েছে, এই সময়ে বিবাদমান পক্ষগুলো যুদ্ধ শেষ করার জন্য কাজ করবে।

তিনি হামাসকে তাদের “চূড়ান্ত প্রস্তাব” গ্রহণ করতে আহ্বান জানান। সঙ্গে তাদের হুঁশিয়ার করে বলেছেন, “পরিস্থিতি এর থেকে আর ভালো হবে না, বরং খারাপই হবে।”

ধারণা করা হচ্ছে যে এই পরিকল্পনায় ইসরায়েলি কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিনিময়ে হামাসের কাছে থাকা ১০ জন জীবিত ইসরায়েলি জিম্মির ধাপে ধাপে মুক্তি এবং ১৮ জন মৃত জিম্মির মরদেহ ফেরত দেয়া অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

গাজায় এখনো ৫০ জন জিম্মিকে আটকে রাখা হয়েছে, যাদের মধ্যে অন্তত ২০ জন জীবিত বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, জাতিসংঘ ও রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটির অংশগ্রহণে গাজায় পর্যাপ্ত মানবিক সহায়তা অবিলম্বে প্রবেশ করবে।

এ বিষয়ে এক জ্যেষ্ঠ ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বলেন, হামাস দাবি করছে এই সহায়তা যেন কেবল জাতিসংঘ ও তাদের অংশীদারদের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়।

সেইসাথে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা যেন সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করা হয়।

ফিলিস্তিনি কর্মকর্তার মতে, হামাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী ছিল ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার বিষয়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে উত্তর ও দক্ষিণ গাজার কিছু অংশ থেকে ধাপে ধাপে সেনা প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

কিন্তু ওই কর্মকর্তা বলেন, হামাস জোর দিয়ে বলেছে যে ইসরায়েলি সেনারা যেন মার্চ মাসে যুদ্ধবিরতি ভেঙে আবার আক্রমণ শুরু করার আগের অবস্থানে ফিরে যায়।

ওই ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বলেন, হামাস আরো চায় যুক্তরাষ্ট্র এমন নিশ্চয়তা দিক যে, যদি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা ব্যর্থ হয়, তাহলেও ইসরায়েল যেন আর বিমান বা স্থল হামলা শুরু না করে।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যুদ্ধ শেষ করার আলোচনা প্রথম দিন থেকেই শুরু হবে।

তবে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, যতদিন না সব জিম্মিকে মুক্ত করা হচ্ছে এবং হামাসের সামরিক ও শাসনক্ষমতা ধ্বংস না করা হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত যুদ্ধ শেষ হবে না।

যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে হামাসের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য যখন অপেক্ষা চলছিল, এরইমধ্যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা উপত্যকা জুড়ে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে বোমা বর্ষণ অব্যাহত রেখেছে।

গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুক্রবার দুপুরে জানিয়েছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ১৩৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

রাতে, দক্ষিণে খান ইউনিস এলাকায় বাস্তুচ্যুত মানুষদের থাকার দুটি তাঁবুতে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ১৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় নাসের হাসপাতাল।

নিহতদের মধ্যে ছিলেন ১৩ বছর বয়সী মায়ার আল-ফার এর ভাই মাহমুদ ।

ভাইয়ের জানাজায় অংশ নেয়ার সময় সংবাদমাধ্যম রয়টার্সকে তিনি বলেন, “এখন যুদ্ধবিরতি আসবে, আর আমি আমার ভাইকে হারালাম? যুদ্ধবিরতি তো অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল, আমার ভাইকে হারানোর আগেই।”

আদলার মুয়াম্মারের ভাগ্নে আশরাফও সর্বশেষ ওই হামলায় নিহত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে… আমরা চাই তারা এই রক্তপাত বন্ধ করুক। আমরা চাই যুদ্ধ থেমে যাক।”

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এই হামলার বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি, তবে বলেছে তারা হামাসের সামরিক সক্ষমতা ভেঙে দিতে অভিযান চালাচ্ছে।

পরে শুক্রবার, আন্তর্জাতিক রেডক্রস (আইসিআরসি) আরো জানিয়েছে যে দক্ষিণ গাজার রাফাহতে তাদের ফিল্ড হাসপাতালের এক কর্মি বিক্ষিপ্ত গোলাগুলিতে আহত হয়েছেন।

আইসিআরসি বলেছে, এই “অগ্রহণযোগ্য” ঘটনার পর তার অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে।

এদিকে, চিকিৎসাসেবী সংস্থা মেডসঁ সঁ ফ্রঁতিয়ার (এমএসএফ) জানিয়েছে, আগের দিন ইসরায়েলি বাহিনী খান ইউনিসে ত্রাণের ট্রাকের জন্য অপেক্ষমাণ লোকজনের ওপর গুলি চালায়। এতে তাদের এক সাবেক সহকর্মি নিহত হয়েছেন।

যখন এই ঘটনায় অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছে বলে নাসের হাসপাতালকে উদ্ধৃত করে এই তথ্য জানিয়েছে এমএসএফ।

এ নিয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এখনও কোনো মন্তব্য করেনি।

গাজায় এমএসএফ-এর জরুরি সমন্বয়কারী আইটর জাবালগোগেজকোয়া বলেছেন, “১০০ দিনের বেশি সময় ধরে পদ্ধতিগত এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনিদের না খাইয়ে রাখায় গাজার মানুষ ভেঙে পড়ছে। এই হত্যাযজ্ঞ এখনই বন্ধ হওয়া উচিত।”

জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর শুক্রবার জানিয়েছে যে, তারা জিএইচএফ-এর ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের কাছে অন্তত ৫০৯ জন এবং ত্রাণের বহরের কাছে আরও ১০৪ জনকে হত্যার ঘটনা রেকর্ড করেছে।

মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি বলেছেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর হতাহতের এই সংখ্যা যাচাই ও দায়ীদের সনাক্ত করতে কাজ করছে।

তিনি আরও বলেন, এটা “পরিষ্কার যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে পৌঁছাতে চাওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালিয়েছে”।

জিএইচএফ জানিয়েছে, জাতিসংঘের এই তথ্য বা পরিসংখ্যান গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে “সরাসরি” এসেছে। যা তাদের তথ্যের মতো এতোটা নির্ভরযোগ্য নয় এবং এসব তথ্য তাদের প্রচেষ্টা “ভুলভাবে কলঙ্কিত” করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।

সংস্থাটির চেয়ারম্যান এ সপ্তাহে জোর দিয়ে বলেন, তাদের স্থান বা তার আশপাশে কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা জিএইচএফ-এর সাইটগুলোর কাছে পৌঁছাতে গিয়ে বেসামরিক মানুষদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর খতিয়ে দেখছে, তবে তারা জোর দিয়ে বলেছে যে সেখানে “বড় ধরনের প্রাণহানির” খবর “মিথ্যা”।

গাজা থেকে মাত্র ৬০ কিমি দূরে, ইসরায়েলের তেল আভিভ শহরে বাকি জিম্মিদের পরিবার ও তাদের সমর্থকরা যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে একটি সমাবেশ করেছে।

তারা ট্রাম্পকে অনুরোধ করে বলেছে, “চুক্তি করুন”, যাতে সব জিম্মি মুক্ত হয়।

পাশের সমুদ্র সৈকতে তারা একটি বিশাল ব্যানার বিছিয়ে দিয়েছে, যেখানে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা এবং লেখা ছিল “সবার জন্য স্বাধীনতা”।

যারা এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন, তাদের মধ্যে ছিলেন রুবি চেন, ইসরায়েলি-আমেরিকান ইতাই চেনের বাবা।

১৯ বছর বয়সী এই সেনা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে দক্ষিণ ইসরায়েলে হওয়া হামলার সময় নিহত হন, যা যুদ্ধের সূচনা করে, এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মতে, তার মরদেহ গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো জিম্মি হিসেবে।

“আমি অনুরোধ জানাচ্ছি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে, আপনি আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং এমন একটি চুক্তি নিয়ে ফিরে আসুন যাতে সব জিম্মি ঘরে ফিরে আসতে পারে,” বলেন মি. চেন।

“ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি চূড়ান্ত, বিস্তারিত চুক্তি হওয়া জরুরি।”

তেল আভিভে এক সমাবেশে জিম্মি দশা থেকে ফিরে আসা কিথ সিগেল বলেন, বন্দি থাকা সকলের মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য একটি “চুক্তি” হওয়া প্রয়োজন
কিথ সিগেল, একজন ইসরায়েলি-আমেরিকান যিনি গত ফেব্রুয়ারিতে হওয়া যুদ্ধবিরতির সময় ৪৮৪ দিন বন্দি থাকার পর মুক্তি পান, তিনিও সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।

“কিবুতজ কফার আজা থেকে আমার অনেক বন্ধু এখনো গাজায় বন্দি অবস্থায় আছে,” তিনি বলেন।

“শুধু একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তিই তাদের সবাইকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে পারে এবং মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি ভালো ভবিষ্যৎ গড়তে পারে।”

বেশিরভাগ ইসরায়েলিদের প্রধান উদ্বেগ হলো যদি যুদ্ধবিরতি না হয় তাহলে বাকি জিম্মিদের ভাগ্যে কী ঘটতে পারে এবং এবং নেতানিয়াহু ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে গাজায় বিমান হামলা জোরদার করার নির্দেশ দিলে কী হবে।

বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু কিবুতজ নির ওজ শহর সফরের সময় প্রতিশ্রুতি দেন, তিনি বাকি সব জিম্মিকে মুক্ত করবেন।

এই এলাকা ইসরায়েল-গাজা সীমান্তের কাছেই এবং ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর এখান থেকে মোট ৭৬ জন বাসিন্দাকে অপহরণ করা হয়েছিল।

“আমি গভীরভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সব জিম্মির ফিরে আসা নিশ্চিত করাই আমার প্রথম কাজ,” তিনি বলেন। “আমরা তাদের সবাইকে ফিরিয়ে আনব।”

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় গাজায় অভিযান শুরু করে, হামাসের হামলায় প্রায় ১,২০০ জন নিহত হয় এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়।

অন্যদিকে গাজায় ইসরায়েলের অব্যাহত হামলায় ৫৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

0 Shares