Home » মতামত » কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প অর্থনৈতিক বিকাশে যুগান্তকারী পদক্ষেপ -এম জসীম উদ্দিন

কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প অর্থনৈতিক বিকাশে যুগান্তকারী পদক্ষেপ -এম জসীম উদ্দিন

আকাশ ভেদ করে নেমে আসছে বাংলাদেশ বিমানের একটি সুপরিসর উড়োজাহাজ, যাত্রীরা দেখতে পাচ্ছে উড়োজাহাজটি সরাসরি সাগরের দিকে নেমে যাচ্ছে।কিঞ্চিত ভীত আবার অন্যদিকে কিছুটা শিহরিত যাত্রীরা। এভাবে কেটে গেল কয়েকটি মুহূর্ত, কিন্তু সব আশঙ্কা এবং দুর্ভাবনাকে পিছু ঠেলে উড়োজাহাজটি সমুদ্রের ওপর নির্মিত কক্সবাজার বিমানবন্দরের রান‌ওয়েতে সফলভাবে অবতরণ করলো। মুহূর্তেই যাত্রীদের চোখে মুখে ফুটে ওঠা অনিশ্চয়তা দূর হয়ে হর্ষধ্বনি এবং করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠল উড়োজাহাজটির অভ্যন্তর। ইনশাআল্লাহ কিছুদিনের মধ্যে এভাবেই স্বপ্ন পূরণের আরেকটি অধ্যায় রচিত হবে বাংলাদেশে। যে স্বপ্নটি বাংলাদেশের মানুষ এতদিন দেখে এসেছে। কারণ এ স্বপ্ন দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১৯৫৬ সালে অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর হিসেবে কক্সবাজার বিমানবন্দর যাত্রা শুরু করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিমানবন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হয়; পরে সংস্কার করে আবার বিমানবন্দর সচল করা হয়। এর পর ধাপে ধাপে কক্সবাজার বিমানবন্দরের আধুনিকায়ন করা হয়েছে। দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে যাচ্ছে কক্সবাজার। সমুদ্রজলের এই বিমানবন্দরের রানওয়ে হবে দেশের দীর্ঘতম।কক্সবাজার শহরের উত্তর প্রান্তে নাজিরারটেক উপকূল। এই রানওয়ে তৈরির জন্য উপকূলের জলবায়ু উদ্বস্তুরা ভিটেমাটি হারিয়ে ছিলো। তাদের পূর্নবাসনের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ করে নামমাত্র মূল্যে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। বেশ আগেই ঝুপড়ি ঘর ছেড়ে উদ্বাস্তুরা ফ্ল্যাটে উঠেছে। ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট বুঝে পেয়েছেন মাত্র এক হাজার এক টাকা পরিশোধে। এমন পরিবারের সংখ্যা ৬ শতাধিক।
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের কক্সবাজার। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সমুদ্র সৈকত সবসময় পর্যটকে মুখরিত থাকে। তবে এরমধ্যে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। এতদিন কক্সবাজার বিমানবন্দরটির রানওয়ের দৈর্ঘ্য কম ও অন্যান্য অবকাঠামোগতঘাটিতি থাকায়, সব ধরনের বিমান চলাচল করতে পারত না। তাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় দৃষ্টিনন্দন সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে আসা বিদেশি পর্যটকদের ঢাকা হয়ে কক্সবাজার যেতে হতো। আর এর ফলে তাদেরকে নানা রকম ভোগান্তির শিকার হতে হতো।এসব ভোগান্তি দূর করার জন্য রানওয়ে এবং টার্মিনাল ভবন সম্প্রসারণের মাধ্যমে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরে উন্নীত করতে, ২০১২ সালে একটি মাস্টার প্ল্যান গ্রহণ করে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। তার মধ্যে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্প অন্যতম। কোরিয়া এই প্রকল্পের কনসালটেন্টের কাজ করছে।

প্রথমদিকে জায়গা না থাকায় রানওয়ে সম্প্রসারণ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতের ভেতরেই দৃষ্টিনন্দন রানওয়ে নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর নানা রকম প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে, ২০২১ সালে শুরু হয় বিশাল কর্মযজ্ঞ।শেষ হয়েছে ১০৫ একর ভূমি উন্নয়নের কাজ। একসঙ্গে চলছে চারপাশে ২ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ। এজন্য ফেলা হচ্ছে ৩০০ কেজি ওজনের বোল্ডার ও ৪ টন ওজনের সিসি ব্লক। যার জন্য প্রথমে সমুদ্রের তলদেশে ব্লক নির্মাণ করা হয়। বিশাল ঢেউ থেকে সুরক্ষা দিতে, কংক্রিট ফেলে গড়ে তোলা হয় বাঁধ। তারপর সেটির ভেতরে বানানো হচ্ছে স্থাপনা।আর বিমান ওঠানামার জন্য সমুদ্রের ২ হাজার ২০০ ফুট অংশে বসানো হচ্ছে লাইট।প্রকল্পের আওতায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রভাব থেকে রানওয়ের সুরক্ষার জন্য সমুদ্র তীরে রক্ষা বাঁধ নির্মাণ এবং বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিতে চারপাশে রাস্তাও নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় সমুদ্রগর্ভে আরও প্রায় ২২০০ ফুট দৈর্ঘ্যের প্রিসিশন এপ্রোচ লাইট স্থাপনসহ বিদ্যমান রানওয়েতে ক্যাট-২ এজিএল সিস্টেম স্থাপন করা হচ্ছে।’দেশে এই প্রক্রিয়ায় এবারই প্রথম কোন স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে।বর্তমানে সমুদ্রের বুক ছুঁয়ে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেরদৃষ্টিনন্দন রানওয়ে নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে।এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে সমুদ্রের বুকে রানওয়ে। আগে কক্সবাজার রানওয়ের দৈঘ্য ছিলো ৬ হাজার ফুট পরে তা ৩ হাজার ফুট বাড়িয়ে ৯ হাজার ফুট করা হয়। বর্তমানে ১ হাজার ৭০০ ফুট সম্প্রসারণের পর কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈঘ্য হবে ১০ হাজার ৭০০ ফুট। বর্তমানে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য ২.৭৪ কিলোমিটার। সম্প্রসারণ কার্যক্রম শেষে আধা কিলোমিটার বেড়ে,নতুন দৈর্ঘ্য হবে ৩.২ কিলোমিটার। আর এই রানওয়ের সম্প্রসারণের কাজ শেষ হলেই এটি হবে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম রানওয়ে। কারন হযরত শাহজালাল (র:) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈঘ্য ১০ হাজার ৫০০ ফুট।
রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ শেষ হলেই শুধু সূর্যের আলোতে আকাশপথে কক্সবাজার যাওয়ার দিনও শেষ হয়ে রাতেও যাত্রী নিয়ে উড়োজাহাজ অবতরণ ও উড্ডয়ন করবে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী চীনা প্রতিষ্ঠান নানা প্রতিকূলতার মাঝেও নির্ধারিত মেয়াদের মধ্য প্রকল্পের কাজ শেষ করার বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ। সমুদ্রের বুকে রানওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের কাজটা সহজ ছিল না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে সমুদ্রের ওপর ১ হাজার ৭০০ ফুট রানওয়ে নির্মাণ কাজ শুরুর পর থেকে নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। বিশেষ করে করোনাকাল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পাশাপাশি ডলার সংকট আর উত্তাল সাগরকে বসে আনাসহ নানা জটিলতা। এসকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে রানওয়ে নির্মাণ কাজ। শুরুতেই চীনা প্রতিষ্ঠান রানওয়ে নির্মাণের জায়গায় সমুদ্রের নিচের নরম মাটি ও কাঁদা সরানোর জন্য ব্যবহার করে সাবমেরিন ড্রেজার। তাছাড়া নেদারল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠান কতৃক আগামী ১০০ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কত হতে পারে সে ব্যাপারে ফিজিবিলেটি স্ট্যাডির রিপোর্টের ভিত্তিতে নবনির্মিত রানওয়ের তিনদিকে সে উচ্চতার অধিক উচ্চতায় বিভিন্ন কংক্রিটের ব্লক ও পাথর ব্যবহার করে সমুদ্র তীররক্ষা বাধ নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে আগামী ১০০ বছরে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্নিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে বিমানবন্দরের ক্ষতি হবেনা । সীমানায় ব্যবহ্রত কংক্রিটের ব্লকগুলো স্থানীয় ভাবে তৈরি করা হলেও পাথরগুলো মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছে । ১৭০০ ফুট রানওয়ে নির্মাণের পর প্রতিরক্ষা মূলক ব্যবস্থা হিসেবে সাগরের আরও ৪/৫শ ফুট পর্যন্ত বিভিন্ন লেয়ারে পাথর ফেলা হয়েছে। এখন রানওয়ের শেষ মাথায় এপ্রোচ লাইটের জন্য ব্রিজ নির্মাণের কাজ চলছে। এপ্রোচ লাইট থেকে সাগরে আলো ফেলে বিমানের গতিপথ নির্ধারণে সহায়তা করা হবে। রানওয়ে নির্মাণের পর যখন কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে বিমান ওঠানামা করবে তখন উড়োজাহাজের দুপাশে থাকবে বঙ্গোপসাগর।
নির্মাণাধীন রানওয়েতে পাঁচটি লেয়ার দেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে একটি লেয়ার দেয়া হয়েছে। আরও তিনটি লেয়ার দেয়া হলে নতুন রানওয়ে পুরনো রানওয়ের সমান হবে। সর্বশেষে একটি লেয়ার সম্পূর্ণ (১০ হাজার ৭০০ ফুট) রানওয়েতে দেয়া হবে। সম্পূর্ণ রানওয়ে নির্মাণ শেষে লাইট গুলো রানওয়ের মাঝে নিয়ে আসা হবে। দৃষ্টিনন্দন এ রানওয়েটি হবে উপমহাদেশের এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সমুদ্র শাসন করে তৈরি করা প্রথম রানওয়ে। বর্তমানে কক্সবাজার বিমানবন্দরে প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০টি যাত্রীবাহী বিমান ও ৬-৮টি কার্গো বিমান ওঠানামা করছে। রাতে বিমান ওঠানামার জন্যও বন্দরটি প্রায় প্রস্তুত। সমুদ্রগর্ভে আরও লাইটিং সিস্টেম স্থাপনের কাজ চলছে।

কক্সবাজার বিমানবন্দরের প্যাসেঞ্জার টার্মিনালের উপরিভাগ ঝিনুক আকৃতির হওয়ায় এর নান্দনিকতা ফুটে উঠবে। টার্মিনালের উপরিংশে স্টিলের স্ট্রাকচার সাগরের ঢেউয়ের মতো হবে যা প্যাসেঞ্জার টার্মিনালের সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিবে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক টার্মিনাল ভবন নির্মাণের কাজও শেষ পর্যায়ে আছে। এখন ভবনের ভেতর ইমিগ্রেশন, বোর্ডিং পাস, লাউঞ্জের কাজ করা হচ্ছে। চলতি বছরেই মধ্যেই সমুদ্রের বুক ছুঁয়ে নির্মিত রানওয়ে দিয়ে বিমান ওঠানামা করবে।প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।বিশ্বখ্যাত এয়ারলাইন্স কোম্পানি এমিরেটস, ইতিহাদ, লুৎফানসা, টার্কিস, সৌদিয়া, কেএলএম, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, থাইএয়ার, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স, চায়না ইস্টানের মতো এয়ারলাইন্স সংস্থাকে পরিকল্পনায় রেখে এ বিমানবন্দর তৈরির কাজ করছে সরকার। কক্সবাজার বিমানবন্দরকে এ অঞ্চরের রিফুয়েলিংয়ের হাব হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে।কক্সবাজার বিমান বন্দরে উড়োজাহাজের রিফুয়েলিং ম্যানেজমেন্ট কার্যক্রমের দায়িত্বটা পদ্মা অয়েল কোম্পানী লিমিটেডকে দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কক্সবাজার বিমানবন্দর বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় রিফুয়েলিং হাব হিসেবে গড়ে উঠবে। পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে বা প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে যতো উড়োজাহাজ যাবে তাদের রিফুয়েলিংয়ের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গা হবে কক্সবাজার। কারণ একেক সময় পৃথিবীর একেকটি জায়গা রিফুয়েলিং হাব হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে । এক সময় হংকং তারপর সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক এখন দুবাই। তাই সময় ও দূরত্ব বিবেচনায় পাশ্চাত্য আর প্রাচ্যের মধ্যবর্তী অবস্থনের কারণে ভবিষ্যতে কক্সবাজারই হবে রিফুয়েলিং হাবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। কেন না খুব স্বল্প সময়ে এখানে বিমান এসে নামতে, রিফুয়েলিং করতে এবং যেতে পারবে।

কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ের সম্প্রসারণ প্রকল্প শেষ হলে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ নতুন ভাবে পরিচিত হবে এবং বিমানবন্দরটি শুধু পর্যটন নয়, দেশের যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক বিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে ।

লেখক: তথ্য অফিসার তথ্য অধিদফতর
-পি. ফি.

0 Shares