Home » মতামত » খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে নাগরিক সচেতনতা ও অংশীজনের ভূমিকা -মোঃ রুপাল মিয়া

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে নাগরিক সচেতনতা ও অংশীজনের ভূমিকা -মোঃ রুপাল মিয়া

 

মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা হচ্ছে খাদ্য। জীব হিসেবে মানুষ খাদ্য গ্রহণ ছাড়া তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। একটি দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি অপরিহার্য। সেই সঙ্গে খাদ্যের পুষ্টিমান বজায় রাখাও আবশ্যক। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও খাদ্য উৎপাদনের মধ্যে সমন্বয় করা না গেলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়। সারাবছর মানুষের পর্যাপ্ত খাদ্যের প্রাপ্যতা ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের অধিকারকে খাদ্য নিরাপত্তা বলে।
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এদেশে জনসংখ্যার তুলনায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কম। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি জনগণকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের অন্যতম অংশীজন হচ্ছে সরকার। খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণে সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার খাদ্যশস্যের নতুন উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনে কাজ করে। একটি দেশের খাদ্যশস্যের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন ব্যবস্থা যত উন্নত হবে, সে দেশের খাদ্যের উৎপাদনশীলতা তত বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য হলো ধান। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সর্বদা বিভিন্ন জাতের উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনে সচেষ্ট। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ১০০টির অধিক উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। উদ্ভাবিত এইসব উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উৎপাদন বৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটও খাদ্যশস্যের উন্নত জাত উদ্ভাবনে কাজ করে। এর ফলে কৃষি উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
খাদ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের কার্যকর ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশে সরকারিভাবে, বেসরকারিভাবে কিংবা পারিবারিকভাবে কিছু কিছু খাদ্যশস্য সংরক্ষণ করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। পারিবারিকভাবে খাদ্য কিংবা খাদ্যশস্য সংরক্ষণেও নানাবিধ অসুবিধা রয়েছে। মৌসুমি খাদ্যশস্যকে এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে সারাবছর তা ব্যবহার করা যায়। বৃহৎ পরিসরে সরকারিভাবে খাদশস্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে, তা খাদ্য নিরাপত্তাকে সহজ করে তুলবে।
খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার প্রতিবছর কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় কৃষকদের মাঝে কৃষি উপকরণ বিতরণ করে। সরকার গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে কৃষি প্রণোদনা ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় ৬৭ লাখ ৬৫ হাজার ৫৭৬ জন উপকারভোগী কৃষকের মাঝে ৪৭ হাজার ৩২ কোটি টাকার কৃষি প্রণোদনা বিতরণ করেছে। কৃষি প্রণোদনা পেলে কৃষকেরা খাদ্য উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ হন। এর পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করা হলে তা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
খাদ্যের অপচয়রোধ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের অন্যতম নিয়ামক। খাদ্যের অপচয়রোধে নাগরিক সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য প্রস্তুত করে তা নষ্ট করা যাবে না। অর্থাৎ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিকের পরিমিত বোধ থাকতে হবে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড়ো অংশ কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের অন্যতম অংশীজন হচ্ছেন কৃষক। কৃষকেরা আধুনিক চাষ পদ্ধতির মাধ্যমে এবং সঠিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক প্রয়োগ করে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারেন। এতে খাদ্য ঘাটতি লাঘব হবে। যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে নিরাপদ খাদ্য ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। শুধু খাদ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না। খাদ্যের পুষ্টিমান খাদ্য নিরাপত্তার অপরিহার্য নিয়ামক। অনিরাপদ ও পুষ্টিহীন খাদ্য গ্রহণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় যাতে খাদ্যের পুষ্টিমান বজায় থাকে তা খেয়াল রাখতে হবে। খাদ্য নিরাপদ রাখার পাঁচটি চাবিকাঠি হচ্ছে -পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, কাঁচা ও রান্না করা খাবার আলাদা রাখা, সঠিক তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময় ধরে খাবার রান্না করা, নিরাপদ তাপমাত্রায় খাদ্য সংরক্ষণ করা এবং নিরাপদ পানি ও খাদ্য উপকরণ ব্যবহার করা।
বাংলাদেশে কৃষি জমিতে কলকারখানাসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের ফলে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। যা খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি বড়ো বাধা। কৃষি জমিতে অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। বিশেষ করে দুই বা তিন ফসলি জমিতে কোনো ক্রমেই অবকাঠামো নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া যাবে না।
বাংলাদেশে প্রতিবছর কম-বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। এই সময় খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। যা খাদ্য নিরাপত্তার উপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। তাই স্বাধীনতার পর থেকে জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা বিধান বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে অগ্রাধিকার পেয়ে আসছে। ইতোমধ্যে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, কৃষি ও অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ এবং ভর্তুকির মাধ্যমে খাদ্যশস্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির বহুমুখি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এইসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য কোনো একক প্রচেষ্টা নয় বরং অংশীদারিত্বভিত্তিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও নাগরিকের সচেতনতা খাদ্য নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করবে এমনটই প্রত্যাশা। (পি. ফি.)

লেখক : সহকারী তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর

0 Shares