-মোঃ সেলিম হোসেন
ঘূর্ণিঝড়, হারিকেন ও টাইফুন শুনতে তিনটি পৃথক ঝড়ের নাম মনে হলেও আসলে এগুলো অঞ্চলভেদে ঘূর্ণিঝড়েরই ভিন্ন ভিন্ন নাম। সাধারণভাবে ঘূর্ণিঝড়কে ঘূর্ণিঝড় বা ট্রপিক্যাল ঘূর্ণিঝড় বলা হয়। ঘূর্ণিঝড় শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘কাইক্লোস’ থেকে, যার অর্থ বৃত্ত বা চাকা। এটা অনেক সময় সাপের বৃত্তাকার কুণ্ডলী বুঝাতেও ব্যবহৃত হয়। ঘূর্ণিঝড় হলো ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে সৃষ্ট বৃষ্টি, বজ্র ও প্রচণ্ড ঘূর্ণি বাতাস সংবলিত আবহাওয়ার একটি নিম্নচাপ প্রক্রিয়া যা নিরক্ষীয় অঞ্চলে উৎপন্ন তাপকে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত করে। এ ধরনের ঝড়ে বাতাস প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে চলে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়ের ঘূর্ণন উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে। আটলান্টিক মহাসাগর এলাকা তথা আমেরিকার আশেপাশে ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ যখন ঘন্টায় ১১৭ কিলোমিটারের বেশি হয়, তখন জনগণকে এর ভয়াবহতা বুঝাতে ‘হারিকেন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। প্রশান্ত মহাসাগর এলাকা তথা চিন, জাপানের আশেপাশে হারিকেন- এর পরিবর্তে ‘টাইফুন’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
আবহাওয়া গত নানা কারণে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য আনুষঙ্গিক কিছু প্রভাবক হলো ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা কমপক্ষে ২৬-২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকা আবশ্যক এবং একটি নির্দিষ্ট গভীরতা (কমপক্ষে ৫০ মিটার) পর্যন্ত এ তাপমাত্রা থাকতে হয়। এজন্য সাধারণত কর্কট ও মকর ক্রান্তিরেখার কাছাকাছি সমুদ্রগুলোতে গ্রীষ্মকালে বা গ্রীষ্মের শেষে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। অন্য কোথাও হয় না; নিরক্ষীয় অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে পৃথিবীপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়ে গেলে উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু হালকা হয়ে ওপরে উঠে যায়। এ শূণ্যস্থান পূরণের জন্য মেরু অঞ্চল থেকে শীতল বায়ু উত্তর গোলার্ধে দক্ষিণে নিরক্ষরেখার দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। কিন্তু পৃথিবীর ঘূর্ণনের প্রভাবে সৃষ্ট করিওলিস শক্তির কারণে এ বায়ু সোজাসুজি প্রবাহিত না হয়ে উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে যায়। এ জন্য আমরা দেখি, উত্তর গোলার্ধে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরতে থাকে। সাধারণত, নিরক্ষরেখার ১০ থেকে ৩০ ডিগ্রির মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় ।
বাতাসের তীব্রতা ও গতি বৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিয়ে ঘূর্ণিঝড়কে ৮টি শ্রেণিতে বিভাজন করা হয়। শ্রেণিগুলো হলো: লঘুচাপ, সুস্পষ্ট লঘুচাপ, নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড়, প্রবল ঘূর্ণিঝড়, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় এবং সুপার সাইক্লোন। বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৩১ কিলোমিটার বা এর নীচে হলে তাকে লঘুচাপ আখ্যায়িত করা হয়। এর গতি বাড়তে বাড়তে ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার হলে তাকে ঘূর্ণিঝড় এবং বাতাসের গতিবেগ ২২২ কিলোমিটার বা এর অধিক হলে সুপার সাইক্লোন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা স্থায়ী আদেশাবলির পরিশিষ্টে সমুদ্র ও নদী বন্দরসমূহের জন্য সংকেতসমূহ এবং দমকা হাওয়ার বেগ, সম্ভাব্য ফলাফল/প্রভাব, বন্দরের জন্য হুশিয়ারি বার্তা এবং জনগণের জন্য বার্তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ের শ্রেণি বিভাজন, সমুদ্র বন্দর এবং নদী বন্দরের জন্য ঘূর্ণিঝড় সতর্ক সংকেত এবং সংকেতসমূহের অর্থ বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার আঞ্চলিক কমিটি প্রতিটি ঝড়ের একটি নাম দিয়ে থাকে। ভারত মহাসাগরের ঝড়গুলোর নামকরণ করে এ সংস্থার আটটি দেশ। দেশগুলো হলো- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড ও ওমান। এ দেশগুলোর প্যানেলকে বলা হয় ডব্লিউএমও/এসক্যাপ (WMO/ESCAP)। অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে ঝড়ের নামকরণ করা হলেও, বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোয় ঝড়ের নামকরণ শুরু হয় ২০০৪ সাল থেকে।
২০০৮ সালে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সভায় দেশের সমুদ্র ও নদী বন্দরসমূহের জন্য বিপদ সংকেত অনুমোদন করা হয়।
সমুদ্রবন্দরের জন্য ঘূর্ণিঝড়ের সংকেতগুলো হলো সংকেত নং ১ অর্থ দূরবর্তী সতর্ক সংকেত জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার পর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সম্মুখীন হতে পারে। দূরবর্তী এলাকায় একটি ঝড়ো হাওয়ার অঞ্চল রয়েছে, যেখানে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬১ কিলোমিটার যা সামুদ্রিক ঝড়ে পরিণত হতে পারে।২ নং দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দূরে গভীর সাগরে একটি ঝড় সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার। বন্দর এখনই ঝড়ে কবলিত হবে না, তবে বন্দর ত্যাগকারী জাহাজ পথিমধ্যে বিপদে পড়তে পারে। ৩ নং স্থানীয় সতর্ক সংকেত বন্দর ও বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলো দুর্যোগ কবলিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্দরে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে এবং ঘূর্ণি বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০-৫০ কিলোমিটার হতে পারে। ৪ নং স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত বন্দর ঘূর্ণিঝড় কবলিত । বাতাসের সম্ভাব্য গতিবেগ ঘণ্টায় ৫১-৬১ কিলোমিটার, তবে ঘূর্ণিঝড়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়ার মত তেমন বিপজ্জনক সময় এখনো আসেনি। ৫ নং বিপদ সংকেতবন্দর ছোটো বা মাঝারি তীব্রতার ঝঞ্চাবহুল এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে নিপতিত। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার। ঝড়টি বন্দরকে বাম দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। ৬ নং বিপদ সংকেত বন্দর ছোটো বা মাঝারি তীব্রতার ঝঞ্জাবহুল এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে নিপতিত। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার। ঝড়টি বন্দরকে ডান দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। ৭ নং বিপদ সংকেত বন্দর ছোটো বা মাঝারি তীব্রতার ঝঞ্জাবহুল এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে নিপতিত। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার। ঝড়টি বন্দরের উপর বা নিকট দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। ৮ নং মহাবিপদ সংকেত বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে নিপতিত। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা তার উর্ধ্বে হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরকে বাম দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করবে। ৯ নং মহাবিপদ সংকেত বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে নিপতিত। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা তার ঊর্ধ্বে হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরকে ডান দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করবে। ১০ নং মহাবিপদ সংকেতবন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে নিপতিত। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা তার উর্ধ্বে হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরের উপর বা নিকট দিয়ে উপকূল অতিক্রম করবে। ১১ নং যোগযোগ বিচ্ছিন্ন সংকেত আবহাওয়া বিপদ সংকেত প্রদানকারী কেন্দ্রের সঙ্গে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং স্থানীয় কর্মকর্তা আবহাওয়া অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ বলে মনে করেন।
নদীবন্দরসমূহের জন্য ঘূর্ণিঝড়ের সংকেতগুলো হলো সংকেত নং ১ অর্থ নৌ সতর্ক সংকেত বন্দর এলাকা ক্ষণস্থায়ী ঝড়ো আবহাওয়ার কবলে নিপতিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার গতিবেগের কালবৈশাখির ক্ষেত্রেও এই সংকেত প্রদর্শিত হয়। এই সংকেত আবহাওয়ার চলতি অবস্থার উপর সতর্ক নজর রাখারও তাগিদ দেয়। ২ নং নৌ হুঁশিয়ারি সংকেত বন্দর এলাকা নিম্নচাপের সমতুল্য তীব্রতার একটি ঝড়, যার গতিবেগ ঘণ্টায় অনূর্ধ্ব ৬১ কিলোমিটার বা একটি কালবৈশাখি ঝড়, যার বাতাসের গতিবেগ ৬১ কিলোমিটার বা তদূর্ধ্ব। নৌযান এদের যে কোনোটির কবলে নিপতিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ৬৫ ফুট বা তার কম দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট নৌযানকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে।৩ নং নৌ বিপদ সংকেত বন্দর এলাকা ঝড়ে কবলিত। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ একটানা ৬২-৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিবেগের একটি সামুদ্রিক ঝড় সহসাই বন্দর এলাকায় আঘাত হানতে পারে। সকল প্রকার নৌযানকে অবিলম্বে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। ৪ নং নৌ মহাবিপদ সংকেত বন্দর এলাকা একটি প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার সামুদ্রিক ঝড়ে কবলিত এবং সহসাই বন্দর এলাকায় আঘাত হানবে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা তদূর্ধ্ব। সকল প্রকার নৌযানকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে হবে।
সমুদ্রবন্দরে বিপদ সংকেত দেয়া হলে সেখানে একেক অবস্থায় একেক সংখ্যক লাল পতাকা টানিয়ে দেয়া হয়। ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কীকরণের জন্য ৩ ভাবে পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৪ নং সতর্ক সংকেত দেখাতে ১টি; ৫, ৬ এবং ৭ নং সংকেত দেখাতে ২টি; এবং ৮, ৯ ও ১০ নং সংকেত দেখাতে ৩টি পতাকা উত্তোলন করা হয়। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে এগুলো করা হয়। এর মাধ্যমে যান মালের ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে দেশকে রক্ষা করা সম্ভব হয়।
লেখক : উপপ্রধান তথ্য অফিসার
-পি. ফি.