আঠারো শতকের শেষার্ধে শিল্পোৎপাদন ইংল্যান্ডে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয় ,সেটিই প্রাথমিকভাবে শিল্পবিপ্লব নামে পরিচিত। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ‘ Industry 4.০ ‘ নামেও পরিচিত। এককথায় ,চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হল প্রযুক্তিগত বিপ্লব;যেখানে পৃথিবী সত্যিকার অর্থেই বিশ্বগ্রামে পরিণত হবে। অর্থনীতি ,রাজনীতি ,সাংস্কৃতিক সর্বোপরি মানুষের সামাজিক জীবনযাপনে আসবে নানান পরিবর্তন।
সৃষ্টির শুরু থেকে মানব সভ্যতার ইতিহাসে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পবিপ্লব পৃথিবীর গতিপথ ব্যাপকভাবে পাল্টে দেয়। প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। ১৮৭০ সালে আবিষ্কার হয় বিদ্যুৎ। যার ফলে গোটা বিশ্ব উন্নয়ন এবং এক বিশাল পরিবর্তনের ছায়ায় আসে এবং তৃতীয় শিল্পবিপ্লব ঘটে ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কারের মাধ্যমে। আর এই ইন্টারনেট আবিষ্কারের ফলই হল আজকের চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধারণাটি ১ এপ্রিল ,২০১৩ সালে জার্মানিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপিত হয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে বলা হয় ডিজিটাল বিপ্লব। ক্লাউস সোয়াব ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডাব্লিউইএফ) প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান ২০১৬ সালে সর্বপ্রথম চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কথাটি ব্যবহার করেন তার ‘ দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোল্যুশন ‘ নামক বইয়ে ,যেখানে একটি প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন ‘ আমরা চাই বা না চাই ,এত দিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা ,কাজকর্ম ,চিন্তাচেতনা যেভাবে চলছে ,সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ‘ ( সোয়াব ২০১৭)
বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় ,শিল্প 4.০ এর চারটি পরিকল্পনা নীতিমালা রয়েছে। আন্তঃসংযোগ – মেশিন, ডিভাইস, সেন্সর এবং মানুষের পরস্পরের মধ্যে ইন্টারনেট অফ থিংস অথবা ইন্টারনেট অফ পিউপল (আইওপি) এর মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন এবং যোগাযোগের ক্ষমতা বৃদ্ধি। তথ্যের স্বচ্ছতা – ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ তথ্যের স্বচ্ছতা দেয় যা অপারেটরদের সিদ্বান্ত নেয়ার জন্য ব্যাপক তথ্য সরবরাহ করে। আন্তঃসংযোগের কারণে অপারেটর উৎপাদন প্রক্রিয়ার সমস্ত পয়েন্ট থেকে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করতে পারে এবং কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। প্রযুক্তিগত সহায়তা – সিদ্বান্ত গ্রহণ এবং সমস্যা সমাধানে মানুষকে সহায়তা করার জন্য সিস্টেমের প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং কঠিন বা অনিরাপদ কাজের ক্ষেত্রে সহায়তা করার ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত – সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেমের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এবং স্বতন্ত্রভাবে তাদের কাজ যথাসম্ভব সম্পাদন করার ক্ষমতা নিবে ।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অন ইনফরমেশন টেকনোলজির মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্সে বলেন , ‘ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সেই সক্ষমতা আছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ,ব্লক চেইন, আইওটি ,ন্যানো টেকনোলজি ,বায়োটেকনোলজি ,রোবোটিক্স ,মাইক্রোপ্রসেসর ডিজাইনের মোট ক্ষেত্রগুলোতে জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ। ‘ তিনি আরো বলেন ,’আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের আইটি খাত একসময় পোশাক রফতানি খাতকে ছাড়িয়ে যাবে। ২০২৫ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারের আইটি পণ্য রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছি আমরা।’
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নত বাংলাদেশের সোপান তৈরি করে গেছেন। বিশ্বে ১৯৬৯ সালে তৃতীয় শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছিলো। বেতবুনিয়ায় উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র স্থাপন, আইটিইউ-ইউপিইউ এর সদস্য পদ অর্জন, টিএন্ডটি বোর্ড গঠন, প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, বাংলা টাইপরাইটার প্রস্তুতকরণ, কুদরত-ই-হুদা শিক্ষা কমিশন গঠন এবং কারিগরি শিক্ষা প্রসারের মধ্য দিয়ে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে অংশগ্রহণের সূচনা বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মোবাইল ফোন সাধারণের নাগালে পৌঁছে দিতে ৪টি মোবাইল কোম্পানিকে লাইসেন্স প্রদান, ভি-স্যাটের মাধ্যমে অনলাইন ইন্টারনেট প্রবর্তন এবং কম্পিউটার সাধারণের জন্য সহজলভ্য করতে ভ্যাট-ট্যাক্স প্রত্যাহার ও তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বিকাশের ব্যবস্থা করে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ পরিপূর্ণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৩ বছরে বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নেতৃত্ব দানের সক্ষমতা অর্জন করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্ব এবং তার গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি তুলে ধরে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফা জব্বার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশনারি নেতৃত্ব এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ দেশে ডিজিটাল সংযোগ স্থাপনে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। ইতোমধ্যে দেশের ১৬০টি দুর্গম ইউনিয়ন ছাড়া প্রতিটি ইউনিয়নে অপটিক্যাল ফাইভারের উচ্চগতির সংযোগ প্রায় সম্পন্ন করা হয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের এমন কোনো অঞ্চল থাকবে না যেখানে উচ্চগতির সংযোগ অপটিক্যাল ফাইভারের থাকবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন। ডিজিটাল প্রযুক্তি বিকাশের অগ্রদূতমোস্তাফা জব্বার বলেন, আগামী ১২ ডিসেম্বর আমরা ফাইভ-জি যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। পৃথিবীর যে ৬/৭টি দেশ ফাইভ-জি প্রযুক্তি যুগে পা দিয়েছে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে একটি বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ফাইভ-জি প্রযুক্তি হবে একটি ডিজিটাল শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি টু-জি, থ্রি-জি কিংবা ৪জি প্রযুক্তির মতো নয় উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ফাইভ-জি প্রযুক্তি হবে পৃথিবীকে বদলে দেয়ার প্রযুক্তি।চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে রয়েছে নানা ধরণের প্রযুক্তি , এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল -কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ,ক্লাউড কম্পিউটিং,ইন্টারনেট অব থিংস, ব্লক চেইন প্রযুক্তি, থ্রিডি প্রিন্টিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, উন্নতমানের জিন প্র্রযুক্তি, বিগ ডেটা অ্যানালাইটিক, হরিজন্টাল ও ভার্টিক্যাল সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, সাইবার সিকিউরিটি,রোবোটিক্স ইত্যাদি।
আরও পড়ুন :
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অডিট ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার উদ্বোধন
বিএনপি নির্বাচন বানচাল করতে চায় —তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ‘এশিয়ান টাইগার’ বলে পরিচিতি পেয়েছে বিশ্বজুড়ে ।এখানকার হাই-টেক পার্কগুলো হবে আগামীদিনের সিলিকন ভ্যালি। বর্তমানে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা ও ৪ হাজার ৫০১টি ইউনিয়ন পরিষদকে ডিজিটাল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। সরকারের প্রধান সেবাগুলো, বিশেষ করে ভূমি নামজারি, জন্মনিবন্ধন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন, ভোটার আইডি কার্ড, ই-টিন সার্টিফিকেট,অনলাইনে ফল,অনলাইনে ফর্ম পূরণ, ই-ফাইলিং, ভার্চুয়াল অফিস, নির্বাচনে ইভিএম প্রযুক্তি,ডিজিটাল পদ্ধতিতে নাগরিকদের সেবা দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। সামাজিক জীবনে এসেছে নানান প্রযুক্তি,যেমন -ফেসবুক,টুইটার,ইন্সট্রাগ্রাম,হোয়াটসএপ ইত্যাদি। এছাড়া, মেডিকেয়ার হেলথ এই এপটি ডিজিটাল পদ্ধতিতে নাগরিকদের সেবার জন্য প্রস্তুত । শিক্ষা ও চিকিৎসায় পরিলক্ষিত হচ্ছে দ্রুত অগ্রগতি ,যা কিনা covid -19 মহামারিতে বাংলাদেশ ছিল সচল ,যেটি বর্তমানেও বিদ্যমান। বাংলাদেশ অবশ্য ইতিমধ্যে ডিজিটাল শিক্ষার প্রথম পর্যায় ফেস তো ফেস পার করে এখন ডিজিটাল শিক্ষার দ্বিতীয় পর্যায় ব্লেনডেড ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থায় আছে। এর ফলে ইউ জি সি সম্প্রতি ব্লেনডেড লার্নিং পলিসি ২০২১ অনুমোদন দিয়েছে। ২০১৯সালেরজানুয়ারিমাসেরউপাত্তঅনুযায়ী, এসডিজি৯এ বলা হয়েছে দেশে মোবাইলফোনের গ্রাহক সংখ্যা ১৫.৭৫ কোটি।২০১৮সালের মে মাসে বাংলাদেশ সফলভাবে প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধুস্যাটেলাইট-১’উৎক্ষেপণ করে।দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ টু-জি মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে।২০২০সালে এ মাইলফলক অর্জনের লক্ষ্য ছিল, যা ২০১৯ সালের জুনেই অর্জিত হয়েছে।একই সময়ে থ্রি-জি ও ফোর-জি সংযোগের হার ৭৯ শতাংশে উন্নীত হয়।এখাতেপ্রতিযোগিতাসক্ষমতাবাড়াতেবাংলাদেশগবেষণাওউন্নয়নেবিনিয়োগবাড়াচ্ছেএবংবিজ্ঞানওপ্রযুক্তিখাতেরউদ্ভাবনকার্যক্রমেপৃষ্ঠপোষকতাদিচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৩০ % তরুণ ,যা সংখ্যায় ৪ কোটি ৭৬ লাখ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হাতিয়ার হবে এই বিশাল তরুণ সমাজ ,যা মানবসম্পদকে আরো মূল্যবান ও নতুন ধারায় গড়ে উঠবে বাংলাদেশ। এছাড়া এই বিপ্লবের ফলে একদিকে জীবনমান উন্নত হবে অন্যদিকে আয় বৃদ্ধি পাবে। আমদানি -রপ্তানি গতিশীল ও বৃদ্ধি পাবে। অনলাইন প্লাটফর্মে কাজ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে অনেক তরুণ। এই তরুণ সমাজকে শিক্ষার যে সুযোগ করে দেয়া হয়েছে তাতে কারিগরি শিক্ষা ও ভোকেশনাল ট্রেনিংয়েরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে । পাশপাশি কম্পিউটার ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে অনলাইনে সবরকম ব্যবসাবাণিজ্য যাতে করতে পারে সেই ব্যবস্থাও সহজলভ্য হয়েছে । সরকার যুবসমাজের কল্যাণে স্টার্ট আপ প্রোগ্রাম নিচ্ছে এবং এ জন্য বাজেটে আলাদা টাকাও বরাদ্দ আছে। বাংলাদেশে এখন ব্রডব্যান্ড সুবিধা প্রায় ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, মোবাইল ফোন সবার হাতে হাতে পৌঁছে গিয়েছে।ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে যোগাযোগ খুব সহজ হয়ে গেছে , ক্রয় বিক্রয়, পণ্যমান সবকিছু জানার একটা সুযোগ হচ্ছে। বাজার সম্পর্কে জানার সুযোগ হচ্ছে। বাজারের চাহিদা ও পণ্যের মূল্য সম্পর্কে জানার সুযোগ হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার ২০০৮ সাল থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য যে উদ্যোম নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সেক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সাথে এগিয়ে যাচ্ছে সমান তালে।সেজন্য যেসব নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে সেগুলোকে বাদ দিয়ে টেকসই উন্নয়নের ফলে মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পর্কিত গবেষণা ও উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং বাংলাদেশ হবে বিশ্বের দরবারে একটি ব্র্যান্ড। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয় ,পুরোপুরি বাস্তব,তেমনি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব টিকিয়ে রাখবে উন্নয়ন ।যার ফল ব্যক্তি শুধু নয় , বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে অনেক দূরে ।#
লেখক-সিনিয়র ইনফরমেশন অফিসার,পিআইডি ,ঢাকা।
পি. ফি.