শাহাদৎ রুমন, নিউটার্ন : হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮-২০১২) কথাসাহিত্যে জনপ্রিয়তা অর্জনের পাশাপাশি টেলিভিশন নাটক নির্মাণের মধ্য দিয়েও পেয়েছিলেন অসামান্য দর্শকপ্রিয়তা। তিনি টেলিভিশন নাটক নির্মাণে স্বকীয় ধারা সৃষ্টি করার সঙ্গে দর্শককে আকৃষ্ট করে অর্জন করেছিলেন জাদুকরী সাফল্য। ফলে সাহিত্য, চলচ্চিত্র প্রভৃতি আলোচনার পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকের নাট্যকাররূপেও আলোচনা, সমালোচনা ও গবেষণার বিশেষ এক চরিত্র হয়ে আছেন তিনি। তাঁর রচিত সাহিত্যসমূহ তিনি টেলিভিশন নাটকে রূপান্তরিত করেন, কিংবা টেলিভিশনে প্রচারিত নাটককে সাহিত্যে রূপান্তর করেন। তৎসঙ্গে তিনি সবশ্রেণির দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিলেন।
তাঁর রচনার গণ্ডি যে মধ্যবিত্ত সমাজ তথা পরিবারের কাহিনির সীমানায় পরিব্যাপ্ত ছিল, সেই মধ্যবিত্ত সমাজ নয় কেবল, উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের দর্শক তাঁকে হৃদয়ের গভীরে স্থান দিয়েছিল। তাঁর এই জনপ্রিয়তার মূলে ছিল নাটকের কাহিনি, চরিত্রায়ণ ও নাটকীয় ঘটনার সমাবেশ; যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তবতাকে স্পর্শ করতে সমর্থ হয়। আরও ছিল হাস্যরস, হিউমার, রোমান্টিসিজম, ট্র্যাজিক উৎসসমূহের বাস্তবানুগ অনায়াস সংযোগ।
হুমায়ূন আহমেদ যে-সময়ে টেলিভিশনের জন্য নাটক রচনা ও পরিচালনা করেন, সেসময় এ দেশে বিটিভি ব্যতীত অন্য কোনো মাধ্যম তথা স্যাটেলাইট টেলিভিশনের ব্যবস্থা ছিল না। আবার বর্তমান যুগের মতো ঘরে ঘরে টেলিভিশনের ব্যবস্থাও ছিল না। তারপরও তাঁর রচিত নাটকসমূহ দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। যদিও টেলিভিশন নাটকের জন্য তাঁর নিজের চিত্রনাট্য রচনার আগেই তাঁরই রচিত জনপ্রিয় দুটি উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর নাট্যরূপ প্রচার করেছিল বিটিভি। নওয়াজীশ আলী খানের ভাষ্যে জানা যায়, সেই নাট্যরূপ ও চিত্রায়ণ নিয়ে হুমায়ুন আহমেদ পরবর্তীসময়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এমনকি তাঁর অনুমতি না নিয়ে নাটক দুটির নির্মাণ বিষয়ে বিটিভিতে পত্র লিখে জানিয়েছিলেন, যেন এই দুটি নাটকের কাহিনিকার হিসেবে প্রাপ্য অর্থের বিষয়টি তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলে মিটিয়ে নেন। এই ঘটনার কয়েক বছর পর বিটিভির প্রযোজকদের বারকয়েক অনুরোধে তিনি টিভি নাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন।
তাঁর রচিত প্রথম টেলিভিশন নাটক ছিল ‘প্রথম প্রহর’। কিন্তু চরিত্র ও কাহিনির কারণে এই নাটকটি নির্মিত হয়নি। পরে তিনি ‘প্রথম প্রহর’ দ্বিতীয়বারের মতো লেখেন। কিন্তু নির্মাণ জটিলতায় সেই কাহিনিও নির্মিত হয়নি। ফলে তিনি তৃতীয়বার ‘প্রথম প্রহর’ নাটক লেখেন এবং সেটি সাপ্তাহিক নাটকরূপে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রচারিত হয়। ‘প্রথম প্রহর’ প্রচারের পরপর মধ্যবিত্ত পরিবার-সমাজের গল্পের বাস্তবানুগ নাট্যধারার ফলে টেলিভিশন নাটকে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। একেবারেই সহজ-সরল-মধ্যবিত্ত সমাজের কাহিনি দর্শক দেখতে পায় টেলিভিশনের পর্দায়।
তারপর টেলিভিশন নাটকের ধারায় হুমায়ূন আহমেদ বিশাল সাম্রাজ্য তৈরি করেন দর্শক হৃদয়ে। তিনি রচনা করেন ‘এইসব দিনরাত্রি’ (১৯৮৫)। এই নাটকটি তিনি মূলত রচনা করেছিলেন, সন্তানদের আবদার অনুযায়ী একটি রঙিন টেলিভিশন কিনবেন বলে। এমনকি তিনি নাটকটির জন্য বেশ কয়েকটি পর্ব রচনা করেন, যেন টেলিভিশন কেনার প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ হতে পারে। নাটকটি প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকপ্রিয়তা পায়। নাটকের চরিত্রগুলো হয়ে ওঠে দর্শকের একান্তজন। ফলে নাটকের অন্যতম চরিত্র ‘টুনি’ মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। নাট্যঘটনার এক পর্যায়ে টুনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পথে ধাবিত হচ্ছে দেখে দর্শক প্রতিবাদ করেন। নানাভাবে দর্শক নাট্যকারকে অনুরোধ করতে থাকেন যেন টুনির মৃত্যু তিনি রচনা না করেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ গল্পের কাহিনিকেই প্রাধান্য দেন। ফলে নাটক শেষ হয়ে গেলে প্রেসক্লাবের সামনে ব্যানারও সাঁটানো হয়, ‘টুনির কেন মৃত্যু হলো, হুমায়ুন আহমেদ জবাব চাই’। ময়মনসিংহ শহরে তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছিল।
এভাবে দর্শক হৃদয়ে আলোড়ন তুলতে সমর্থ হয় ‘এইসব দিনরাত্রি’ ধারাবাহিক। দর্শক হৃদয়ে এই আলোড়ন তোলার মূলে অভিনেতাদের অভিনয়শৈলীর পাশাপাশি হুমায়ূন আহমেদের গল্প বয়ানের ঢং-ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকের চরিত্র শফিক, রফিক, নীলু ও টুনি কাউকেই অপরিচিত কিংবা অচেনা কেউ মনে হয় না দর্শকের কাছে। বরং প্রতিটি চরিত্রই দর্শকের আশেপাশের চেনা চরিত্র হয়ে ওঠে; হয়ে ওঠে অতি আপনজন। সেইসঙ্গে এ দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গিন অবস্থা, অনিয়ম, আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর করুণচিত্রও তিনি তুলে ধরেছিলেন নাট্যকাহিনিতে। এ যেন মধ্যবিত্ত জীবনের অমোঘ পাঁচালি।
দর্শক হৃদয়ে এরূপ আলোড়ন তুলেছিল তাঁর ‘কোথাও কেউ নেই’ (১৯৯২-১৯৯৩) নাটকটিও। উক্ত নাটকে গল্পের প্রয়োজনে ‘বাকের ভাই’ চরিত্রের ফাঁসি হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে দেশব্যাপী দর্শকদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র বাকের ভাই। তিনি মহল্লার একজন ট্রিপিক্যাল মাস্তান। তাকে দেখলে লোকে ভয় পায়। অথচ এই মাস্তান চরিত্রটিই একসময় এদেশের টেলিভিশনের দর্শকদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে যে অন্যায় বিচার হয়, সেই বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। মূলত, বাকের ভাই চরিত্রের পোশাক, গান, আচার-আচরণ, মানবতাবোধ, মুনার প্রতি তাঁর প্রেমের স্নিগ্ধতাকে দর্শক বিশেষভাবেই গ্রহণ করেছিল। ফলে স্লোগান ওঠে, ‘বাকের ভাইয়ের ফাঁসি দেওয়া চলবে না’, ‘বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’ প্রভৃতি। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন গল্পের প্রতি দায়বদ্ধ। তাই তিনি গল্পের দাবিকে মেনে নিয়ে বাকের ভাইয়ের ফাঁসির পরিবর্তন করেননি। অতঃপর নাটকটি শেষ হলে দর্শকরা বদি চরিত্র রূপায়ণকারী আবদুল কাদের-এর বাসায় পর্যন্ত কাফনের কাপড় প্রেরণসহ নানাবিধ হুমকিও প্রদান করেছিল। ফলে বহুদিন অবধি এক প্রকার পালিয়ে থাকার মতোই জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন অভিনেতা আবদুল কাদের। কেননা, বদির মিথ্যা সাক্ষ্যের জন্যই বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়ে যায়। উল্লেখ্য, বাকের ভাই চরিত্রের প্রিয় গান, ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে’ গানটিও দর্শকের মুখে মুখে ছিল। এমনকি নাটকের সংলাপ হিসেবে আগত, ‘কুত্তাওয়ালী’, ‘মাইরের মধ্যে ভাইটামিন আছে’, ‘কুকররে কুত্তা কইলে মাইন্ড করে’ প্রভৃতিও বিশেষভাবে দর্শকের কাছে আদৃত হয়েছিল। এ ছাড়া অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর তাঁর অভিনীত চরিত্র বাকের ভাই নামেই পরিচিতি অর্জন করেন।
এসব ঘটনা থেকে এমনও মনে করা যায় যে, হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রদের দর্শক বাস্তবিক মানুষ হিসেবেই গ্রহণ করেছিল। তাঁরা অভিনেতাদের অভিনয়শিল্পীর পরিবর্তে কাছের মানুষরূপেই হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট উপর্যুক্ত টুনি ও বাকের ভাই চরিত্রের জন্য দর্শকের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তা বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের ক্ষেত্রে বিশেষভাবেই স্মরণীয়। কেননা, এ ছাড়া অন্য কোনো চরিত্র কিংবা নাটকের ক্ষেত্রে এমনতর প্রতিবাদ কখনোই দেখা যায়নি। তবে হুমায়ূন আহমেদ গল্পের প্রতি সর্বদা সৎ থাকার চেষ্টা করেছেন। কখনোই দর্শক কিংবা অন্য কোনো চাপের কাছেই নতি স্বীকার করেননি। যদিও তাঁর লিখিত ‘প্রথম প্রহর’ নাটকের ক্ষেত্রে একপ্রকার নতি স্বীকার করতে হয়। কিন্তু উক্ত নাটকের ক্ষেত্রেও তিনি সম্পূর্ণ কাহিনি পরিবর্তন করেছেন, কোনোভাবেই পরিবর্ধন কিংবা পরিমার্জন করেননি। নাট্যকার হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ সর্বদাই এই সততাকে ধারণ করে গেছেন। ফলে তৎসময়ে ‘বহুব্রীহি’ (১৯৮৮-১৯৮৯) ধারাবাহিকের ‘তুই রাজাকার’ সংলাপটি বাদ দেওয়ার অনুরোধ আসলেও তিনি তা বাদ দেননি। পরে ‘তুই রাজাকার’ সংলাপটি দর্শকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। সময়টা যদিও ছিল স্বৈরশাসক এরশাদের সময়কাল। উপরন্তু, নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ কোনোরূপ আপোষ করেননি সংলাপের সঙ্গে। তাঁর এমন দৃঢ় মানসিকতার ফলেই সেইসময়ে উক্ত সংলাপটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যানার, স্লোগানেও স্থান করে নিয়েছিল। অন্যদিকে উক্ত নাটকের ডাক্তার চরিত্রকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে- এই অভিযোগে ঢাকার রাস্তায় প্রতিবাদ করেন, এমনকি তাঁর বই পুড়িয়ে ফেলেন ডাক্তারগণ। এমনকি নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।
আরও জানা যায়, একদিন হলি ফ্যামেলি হাসপাতালে উক্ত নাটকের একটি দৃশ্যের চিত্রায়ণের (অপারেশন) জন্য গেলে উক্ত হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারগণ সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেছিলেন। আবার নাটকের কাহিনিতে ঘটনার পরম্পরায় আসা পাকুন্দিয়া কলেজের প্রসঙ্গও আসতে পারে। কেননা, বাস্তবের পাকুন্দিয়া কলেজের অধ্যক্ষ তাঁর কলেজের সম্মানহানি হয়েছে উল্লেখ করে আইনের আশ্রয় নেবেন জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন বিটিভির প্রযোজক নওয়াজীশ আলী খানকে।
বস্তুত, হুমায়ূন আহমেদের নাটকসমূহ সেইসময়ে এতটাই আলোড়ন তুলেছিল যে, দর্শক আর নাটকের ঘটনাকে অবাস্তব-কাল্পনিক কিংবা নাটক হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ পাননি। বরং নাটকে ঘটে যাওয়া সবকিছুকেই বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছেন। হয়তো এ কারণেই ‘বহুব্রীহি’র বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছিল।
হুমায়ূন আহমেদের আরও একটি জনপ্রিয় নাটক ‘অয়োময়’ (১৯৯০-১৯৯১)। সমাজে বিরাজমান সামন্তবাদী চেতনা ও শোষণের রূপান্তরিত রূপকে তিনি সাবলীলভাবে নাটকে স্থান দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা উত্তর বুর্জোয়া কিংবা আধা সামন্তবাদী মানসিকতার যে বীজ মধ্যবিত্ত সমাজে বিকশিত হতে শুরু করেছিল, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ‘অয়োময়’-এর চরিত্রসমূহের যাপিত জীবন পরিক্রমায়। ফলে ‘অয়োময়’ও হয়ে ওঠে নানান শোষণে ক্লিষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণির আপন দৃশ্যগাথা। এই নাটকটি নিয়েও প্রতিবাদের মুখে পড়েছিলেন তিনি।
নাটকের সংলাপ ‘ঢোল, পশু ও নারী- এদের সব সময় মারের উপর রাখতে হয়’- এ জন্য প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন একদল নারী। তাঁরা নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদকে নারী বিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত করে বিভিন্ন চিঠি লিখে প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁর আরও কয়েকটি জনপ্রিয় নাটক হলো, নক্ষত্রের রাত (১৯৯৪), আজ রবিবার (১৯৯৬), সবুজ ছায়া (১৯৯৭), নিমফুল (১৯৯৭), সবুজ সাথী (১৯৯৮), জোছনার ফুল (১৯৯৮), হাবলঙ্গের বাজার (২০০০), উড়ে যায় বকপক্ষী (২০০৪) প্রভৃতি।
নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের এই দর্শকপ্রিয়তা অর্জনের পেছনে সক্রিয় ছিল বেশকিছু বিষয়াদি। তিনি যেমন মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার বাস্তবানুগ অথচ শৈল্পিক ও নাটকীয় কাহিনি বয়ান করেছেন, তেমনি মধ্যবিত্ত মানুষের স্বপ্ন, বাউলিয়ানা, প্রেম-বিরহ, আনন্দ-বেদনা, আবেগ-অনুভূতি, হাস্যকৌতুক’সহ তাদের চারপাশের টুকিটাকি নানান বিষয়কে যত্নসহকারে নাট্যরূপে স্থান দিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষের ভাষাকে জীবনঘনিষ্ঠরূপে সংলাপে নিয়ে এসেছিলেন। এই প্রক্রিয়াটি তিনি অতীব সযত্নে করেছিলেন তাঁরই পরিচিত বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের কথ্যভাষা ও জীবনবোধকে লালন করার মধ্য দিয়ে।
হুমায়ূন আহমেদের বিশেষত্ব ছিল সংলাপ, দৃশ্য ও চরিত্রের মানসিক অবস্থার চিত্ররূপ রচনায়। তাঁর নাটকে বহুদৃশ্যের সংযোগ ঘটেছে। প্রতিটি দৃশ্যে এসেছে স্বল্পসংখ্যক ছোটো ছোটো সংলাপ। সেইসঙ্গে চরিত্রের চারপাশকে তিনি দৃশ্যায়নে গুরুত্ব প্রদান করেন। ফলে কেবল মানুষ নয়, প্রকৃতি এবং প্রাণীও হয়ে উঠে তাঁর নাটকের বিশেষ অংশ। সাধারণ মানুষ তাঁর এমনতর চিন্তার প্রতিফলনে যেন নাটকে নিজেকেই আবিষ্কার করেন, আবিষ্কার করেন নাট্যচরিত্রসমূহ তারই পরিচিত এক গণ্ডির ভেতর বাস করছে। সেই পরিচিত গণ্ডির ভেতর হুমায়ূন আহমেদ একটি পরিবার এবং তার আশেপাশের জীবনচিত্রই ফুটিয়ে তোলেন। যার মধ্যে থাকে, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, প্রেমিক-প্রেমিকা, কাজের লোক প্রমুখ পরিচয়ের বিচিত্র চরিত্রসমূহ।
লক্ষ্য করা যায়, সহজ-সরল-নির্লিপ্ততা, রসিকতা, হেঁয়ালিপনা, দার্শনিকতায় উত্তুঙ্গ এক রূপের বহুর সম্মিলন তাঁর চরিত্রসমূহের মধ্যে প্রোথিত থাকে। আবার জীবনের নানান বাঁকে থেকে যাওয়া দুঃখ-যন্ত্রণার ট্র্যাজিকরূপও তাঁর চরিত্রসমূহ এমনভাবে ধারণ করে যেনবা তা বাস্তবের মানুষেরই না-পাওয়ার বেদনা ও যন্ত্রণাকে ধারণ করে আছে। তাঁর ‘নক্ষত্রের রাত’ নাটকটি তেমনই এক কাহিনি, যেখানে মনীষা কিংবা মবিন, কিংবা ময়নার ট্র্যাজিক মর্মবেদনা প্রায় প্রত্যেক দর্শককেই যেন ছুঁয়ে যায়। মনে হয় এ যেন বাস্তবিক মানুষেরই যন্ত্রণার প্রতিরূপ। আবার ‘আজ রবিবার’ নাটকে বিভিন্ন চরিত্রের উদ্ভট ও অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দর্শক লাভ করে অনাবিল আনন্দ।
হুমায়ূন আহমেদের নাটকের আরেক অনুষঙ্গ ছিল গান। তিনি নাটকের জন্য যেমন নিজে গান রচনা করেছেন, তেমনি লোকপ্রিয় কিংবা মানুষের কাছে ‘লোকসংগীত’ হিসেবে পরিচিত বাউলদের গানও বেছে নিয়েছিলেন। ফলে তাঁর নাটকে ব্যবহৃত গানসমূহও দর্শকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল। হুমায়ূন আহমেদ নাটকের জন্য গানকে নাটকে স্থান দেননি, বরং নাট্যঘটনার পরম্পরায়ই গান হয়ে উঠেছিল আবশ্যক এক উপাদান। টেলিভিশন নাটককে তিনি জনমানুষের আনন্দ-বিনোদন, জীবন উপলব্ধির এক অনুষঙ্গরূপেই মানুষের সম্মুখে উপস্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনের টানাপোড়েন এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিসমূহ পরম মমতায় রূপায়িত করতে পেরেছেন। ফলে তিনি পেয়েছিলেন অসামান্য দর্শকপ্রিয়তা। যে দর্শকপ্রিয়তা একসময় তাঁর পাঠকপ্রিয়তাকেও আকাশচুম্বী করে তুলেছিল। অর্থাৎ কথাসাহিত্যিকরূপে তিনি যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, সেই জনপ্রিয়তা অর্জনেও তাঁর রচিত টেলিভিশন নাটকসমূহের ভূমিকাও ছিল অগ্রগণ্য। এ কারণেই গত শতাব্দীর শেষ দশকে তাঁর নাটক ব্যতীত টেলিভিশনের কোনো ঈদ নাটক কল্পনা করা যেত না।
সর্বোপরি, টেলিভিশন নাটক রচনার মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ কেবল জনপ্রিয়-দর্শকপ্রিয় নাট্যকার হিসেবেই পরিচিত হননি, সূচনা করেছিলেন টেলিভিশন নাটকের একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়; টেলিভিশন নাটককেও করে তুলেছিলেন নাট্যকারের শিল্প।
নিউটার্ন/এআর