দেশের বাজারে শীতকালীন সবজি আসতে শুরু করেছে। এতে কিছুটা কমতির দিকে কিছু সবজির দাম। তবে বেগুন, করোলা, শিম, বরবটি, কাঁকরোল, টমেটো, গাজর ১০০ টাকা কেজি বা তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আর আলু বিক্রি হচ্ছে বছরের সর্বোচ্চ দামে। (সূত্র: কালের কণ্ঠ , ৯ নভেম্বর ২০২৪)
একই পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে এক ভোক্তার কথা তিনি বলেছেন, এই সময় বেশির ভাগ সবজির মৌসুম শেষ হয়ে যায়, শীতের সবজি আসার অপেক্ষায় আছেন কৃষকরা। সে কারণে সবজির দাম একটু বেশি। আবার একেবারে নতুন কিছু সবজি উঠেছে, যেগুলোর দাম শুরুতে বেশি থাকে। তবে শীতের সবজি বাজারে চলে এলে দাম অনেক কমে যাবে। এখন বাজারে সবজির সরবরাহ কিছুটা কম, ফলে ধীরে কমছে দাম।
দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে আলু আমদানি বাড়ছে। এই স্থলবন্দর দিয়ে গত বৃহস্পতিবার (৮ নভেম্বর) ভারত থেকে ৭১ ট্রাকে আলু এসেছে ১ হাজার ৮১৮ টন। সর্বশেষ শনিবার ৭৪ ট্রাকে এসেছে ১ হাজার ৮৫৩ টন। এটি এই বন্দর দিয়ে এক দিনে সর্বোচ্চ আমদানি। সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় কেজিতে আলুর দাম কমেছে চার টাকা। এক দিন আগেও বন্দরে প্রকারভেদে আলু বিক্রি হয়েছে ৫৫-৫৭ টাকা, যা বর্তমানে কমে ৫১-৫৩ টাকা। (সূত্র: ইত্তেফাক , ১০ নভেম্বর ২০২৪)
দাম বেড়েছে তেল, চাল, ডাল, পেট্রোল ও ডিজেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের একথা সত্য। পণ্য ও পরিষেবার দাম বাড়ছে। এতে সবচেয়ে বিপদে পড়ছে সাধারণ নিম্নবিত্ত, কৃষক, শ্রমিক এবং দিন-আনি-দিন-খাই রোজগারের মানুষজন। দাম বাড়ার অনেক কারণ হয়তো বলা যাবে। মোটাদাগে প্রাকৃতিক কারণে উৎপাদন কম হওয়া (অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ঝড় ইত্যাদি), আমদানির ওপর নির্ভরশীল পণ্যের উৎস দেশে মূল্য বৃদ্ধি, ডলারের বিনিময় হার ইত্যাদি। আবার সরবরাহ চেইনে ইচ্ছাকৃত নানারকম বাঁধাও পণ্যের দাম বাড়তে ভূমিকা রাখে।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো হতে সহজেই অনুমেয় নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়লে বাজার একরকম আচরণ করে অর্থাৎ দাম কমে, আর নিত্যপণ্যের ঘাতটি থাকলে দাম বৃদ্ধি হয়। ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়ান।
দেশের কৃষি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করে কৃষি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের মিশন – ফসলের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, শস্য বহুমুখিকরণ, পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ ফসল উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা আধুনিকায়নের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদন, পণ্যের ট্যারিফ নির্ধারণ, বাণিজ্য সংক্রান্ত গবেষণা কার্যক্রম, তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ ইত্যাদি। সে হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোক্তার সাথে কাজ করে,তাদের ভোগান্তি লাঘবে কাজ করে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ৮ আগস্ট প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। সে হিসেবে সরকারের ৩ মাস পূর্ণ হয়েছে। এসময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। পদক্ষেপগুলোর কারণেই কিছুটা হলেও বাজারে স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে।
দেশে পেঁয়াজ ও আলুর বাজার মূল্য কমানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার আলু ও পেঁয়াজের ক্ষেত্রে শুল্ক হ্রাস করেছে। আলুর ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্কহার ৩৩% হতে ১৫% কমিয়েছে এবং পেঁয়াজের ক্ষেত্রে ১০% হতে কমিয়ে ৫% করেছে, এর ফলে আলু ও পেঁয়াজের বাজারদর হ্রাস পেয়েছে।
পরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পরিশোধিত পাম তেল স্থানীয় উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে তাদের উপর আরোপণীয় সমুদয় মূল্য সংযোজন কর থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।
দেশে ভোজ্যতেলের মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার পরিশোধিত সয়াবিন তেল, অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, অপরিশোধিত পাম তেল এর আমদানি পর্যায়ে আরোপণীয় মূল্য সংযোজন কর ১৫% (পনেরো শতাংশ) থেকে হ্রাস করে ১০% (দশ শতাংশ) করা হয়েছে।
দেশে ডিমের মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ডিমের আমদানির ক্ষেত্রে আরোপণীয় কাস্টমস ডিউটি ২৫% (পঁচিশ শতাংশ) থেকে হ্রাস করে ৫% (পাঁচ শতাংশ) করেছে।
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহ চেইন তদারক ও পর্যালোচনার জন্য ০৭ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক জেলা পর্যায়ে ১০ (দশ) সদস্য বিশিষ্ট একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বা উপযুক্ত প্রতিনিধি, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বা উপযুক্ত প্রতিনিধি,জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বা উপযুক্ত প্রতিনিধি, কৃষি বিপণন কর্মকর্তা/সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা, ক্যাবের প্রতিনিধি, শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ০২ (দুই) জন, সহকারী পরিচালক এবং জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি: ক. টাস্কফোর্স নিয়মিত বিভিন্ন বাজার, বৃহৎ আড়ত, গোডাউন/ কোল্ড স্টোরেজ ও সাপ্লাই চেইনের অন্যান্য স্থানসমূহ সরেজমিনে পরিদর্শন করবে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার বিষয়টি তদারক করবে; খ. টাস্কফোর্স উৎপাদন, পাইকারি ও ভোক্তা পর্যায়ের মধ্যে যাতে দামের পার্থক্য ন্যূনতম থাকে তা নিশ্চিত করবে ও সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সাথে মত বিনিময় সভা করবে; গ. টাস্কফোর্স প্রতিদিনের মনিটরিং শেষে একটি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল (হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর ০১৯১২-৯৩০৫৯২ ও ই-মেইল atc2.pmfc@mincom.gov.bd) এবং জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে (হোয়াটস্অ্যাপ নম্বর ০১৭১১-২৭৩৮০২ ও ই-মেইল: dd- operation@dncrp.gov.bd) প্রেরণ করবে, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদন সংকলন ও পর্যালোচনা করে প্রতিদিন সন্ধ্যা ০৭.০০ টার মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন প্রেরণ করবে; ঘ. টাস্কফোর্স প্রয়োজনে সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে। ঙ. যে সকল জেলায় জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক পদ শূন্য রয়েছে সে সকল জেলায় জেলা প্রশাসক একজন উপযুক্ত কর্মকর্তাকে সদস্য সচিবের দায়িত্ব প্রদান করবেন।
‘রপ্তানি নীতি ২০২৪-২৭’ গত ১৫ অক্টোবর ২০২৪ তারিখ বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়েছে। ভোগ্যপণ্যের বাজার মনিটরিং এর লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব মনিটরিং টিমের পাশাপাশি জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর দেশব্যাপী ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করছে। উল্লেখ্য যে, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কর্তৃক আগস্ট ২০২৪ থেকে অক্টোবর ২০২৪ তারিখ পর্যন্ত সারাদেশে ৩৩৫৩টি বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হয়। বাজার অভিযানের মাধ্যমে ৬৫৭৩টি প্রতিষ্ঠানকে দণ্ডিত করা হয় এবং দণ্ডিত প্রতিষ্ঠান হতে ৩, ৯৪,৫৫,৭০০/-(তিন কোটি চুরানব্বই লক্ষ পঞ্চান্ন হাজার সাতশত) টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
সমগ্র দেশের প্রায় ০১ (এক) কোটি পরিবারের মাঝে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যাদি বিক্রয় কার্যক্রম জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) অনুমোদিত ডিলারের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। টিসিবির কার্ডধারী উপকারভোগী ০২ (দুই) কেজি মশুর ডাল প্রতি কেজি ৬০/-টাকা, ও ০২ (দুই) লিটার ভোজ্যতেল পেট বোতলজাত প্রতি লিটার ১০০/-টাকা এবং খাদ্য অধিদপ্তরের ০৫ (পাঁচ) কেজি করে চাল প্রতি কেজি ৩০/-টাকা দরে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রয় কার্যক্রম চলমান আছে।
১৬ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে গাজীপুরে ১,০০০ (এক হাজার) জন গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাঝে ০২ (দুই) কেজি মশুর ডাল, ০২ (দুই) লিটার ভোজ্যতেল এবং খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রাপ্ত ০৫ (পাঁচ) কেজি করে চাল পূর্ব নির্ধারিত ভর্তুকি মূল্যে বিক্রয় কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
২৪ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখ হতে ঢাকা মহানগরীতে ৫০টি ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২০ টি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ কার্যক্রম ৩০ নভেম্বর, ২০২৪ খ্রি. তারিখ পর্যন্ত চলবে। এ কার্যক্রমে জনপ্রতি ০২ (দুই) কেজি মশুর ডাল, ০২ (দুই) লিটার ভোজ্যতেল এবং খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রাপ্ত ০৫ (পাঁচ) কেজি করে চাল বিক্রয় করা হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর কিছু আছে যেগুলোর সুবিধা দ্রুতই ভোক্তা পাচ্ছে। আবার কিছু পদক্ষেপ আছে যেগুলো দীর্ঘমেয়াদি। যার সুফল ভোগ করতে সময় লাগবে। ভোক্তাকে একটু স্বস্তি দিতে সরকার কাজ করছে। সেদিক বিবেচনায় পদক্ষেপগুলো প্রশংসার দাবি রাখে।
লেখক: সিনিয়র তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর