‘অভিযোগ’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নন এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মূলত শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ক্ষতি হলে কিংবা কোনো অনিয়ম হলে মানুষ অভিযোগ করে থাকেন। অভিযোগের লক্ষ্য হলো অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি প্রদান। তবে অভিযোগ করলেই অভিযুক্তি ব্যক্তি শাস্তি পাবেন এমনটা নয়। কারণ অভিযোগ অনেক সময় ভিত্তিহীন হিসেবে প্রমাণিত হয়। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মানুষকে বিভিন্ন অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয়। তাই ক্ষেত্রবিশেষে অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থায় ভিন্নতা রয়েছে।
রাষ্ট্র একটি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের সেবার মান বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন জনসেবা প্রদানকারী দপ্তরসমূহের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা। এতদুদ্দেশ্যে অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা (Grievance Redress System-GRS) একটি কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং যে কোনো প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও কার্যকারিতা পরিমাপের অন্যতম সূচক হিসেবে এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২১ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য’। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিশ্রুত সেবা, সেবা প্রদান পদ্ধতি এবং সেবা ও পণ্যের মান সম্পর্কে নাগরিকের অসন্তুষ্টি বা সংক্ষুব্ধতা দূর করার জন্য অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বপ্রণোদিতভাবে সেবা প্রদানের মনোবৃত্তি বিকাশে এই অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের অনেকেই জানেন না সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে সংক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি কিভাবে তার অভিযোগ জানাবেন।
সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে সংক্ষুব্ধ যেকোনো ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে উপস্থিত হয়ে অথবা ডাকযোগে, ইমেইলে, ই-ফাইলে অথবা কল সেন্টারের মাধ্যমে কিংবা অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা-সংক্রান্ত ওয়েবসাইট (www.grs.gov.bd)-এর মাধ্যমে অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। সকল সরকারি দপ্তরে সেবা-সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ এবং তা প্রতিকারের জন্য একজন অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তা (অনিক) দায়িত্ব পালন করেন।
ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থায় একজন নাগরিক নিবন্ধনপূর্বক নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য সেবা-সংশ্লিষ্ট অভিযোগ করতে পারেন অথবা ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রেখে অজ্ঞাতনামা হিসেবে অভিযোগ করতে পারেন। অজ্ঞাতনামা হিসেবে অভিযোগ দায়ের করলে অভিযোগটির ওপর কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে কিনা, সে বিষয়ে অভিযোগের ধরন/গুরুত্ব অনুযায়ী অনিক যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
তবে ধর্মীয়, আদালতে বিচারাধীন, তথ্য অধিকার, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে গৃহীত বিভাগীয় মামলা অথবা আইন বা বিধির আওতায় রিভিউ/আপিলের সুযোগ রয়েছে এরূপ বিষয়-সংশ্লিষ্ট অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না। দাখিলকৃত অভিযোগটি নিষ্পত্তি হয়ে গেলে অভিযোগকারীকে এসএমএস ও ইমেইল এর মাধ্যমে জানানো হয়। সাধারণভাবে অভিযোগ নিষ্পত্তির সর্বোচ্চ সময়সীমা ৩০ কার্যদিবস। তদন্তের বিষয় গৃহীত হলে অতিরিক্ত ১০ কার্যদিবস সময়ের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়। অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তা কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থায় অভিযোগকারী যদি সন্তুষ্ট না হয়ে থাকেন তবে, তিনি আপিল করতে পারেন। আপিল কর্মকর্তা হলেন অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তার ঊর্ধ্বতন অফিসের অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তা। আপিল কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার সময়সীমা ২০ কার্যদিবস। আপিল করার পর আপিল কর্মকর্তার সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হলে অথবা সন্তুষ্ট না হয়ে থাকলে অভিযোগকারী পুনরায় আপিল করতে পারেন। পুনরায় আপিলের ক্ষেত্রে আপিলটি সরাসরি অভিযোগ ব্যবস্থপনা সেলের (মন্ত্রীপরষদ সচিবের তত্ত্বাবধানে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সেল) নিকট প্রেরিত হবে। উল্লেখ্য যে, সেল কর্তৃক অভিযোগ নিষ্পত্তির সময়সীমা ৬০ কার্যদিবস এবং সেল কর্তৃক সুপারিশ প্রদানের পর মন্ত্রণালয়/বিভাগ তা ২০ কার্যদিবসে নিষ্পত্তি করবে। অভিযোগ নিষ্পত্তির সঙ্গে সঙ্গে ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে অথবা ডাকযোগে বা বাহকের মাধ্যমে ৭(সাত) কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগকারীকে অভিযোগের ফলাফল সম্পর্কে অবহিত করা হয়।
ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থায় যেকোনো নাগরিক যেকোনো সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি, সেবা সহজিকরণ, সংশ্লিষ্ট আইন/বিধি সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত বা মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করতে পারবেন।
কোনো অভিযোগকারী অভ্যাসগতভাবে অসত্য এবং কাউকে হয়রানি করার জন্য কিংবা অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে অভিযোগ দাখিল করেন মর্মে প্রমাণিত হলে অনিক-এর সুপারিশের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট আপিল কর্মকর্তা উক্ত অভিযোগকারীকে কালো তালিকাভুক্ত করতে পারবেন। এরূপ কালো তালিকাভুক্ত ব্যক্তির নিকট থেকে প্রাপ্ত কোনো অভিযোগ কর্তৃপক্ষ বিনা পদক্ষেপে খারিজ করতে পারবেন এবং পরবর্তী সময়ে ঐ ব্যক্তিকে কালোতালিকা হতে অব্যাহতি না দেয়া পর্যন্ত আর কোনো অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন না। তাই প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। অর্থাৎ অভিযোগের বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে অভিযোগ করাই শ্রেয়।
সেবাপ্রত্যাশীদের সেবা প্রদান করা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কর্তব্য। সেবাপ্রত্যাশীদের অসন্তুষ্টি সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিকার চাওয়া বা বক্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি কার্যকর পদক্ষেপ। তাই নাগরিকগণ অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থায় নিজেদের যত সম্পৃক্ত করতে পারবেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কর্তব্যে অবহেলার পথ তত রুদ্ধ হবে এবং মানসম্মত সেবা নিশ্চিত হবে।
-পি. ফি.
লেখক : সহকারী তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর