Home » মতামত » মানবসম্পদ উন্নয়নে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভূমিকা -অর্জুন কুমার রায়

মানবসম্পদ উন্নয়নে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভূমিকা -অর্জুন কুমার রায়

 

 

একজন মানুষের কর্মদক্ষতা যত উন্নত, তার কর্মক্ষেত্রের পরিধি তত প্রশস্ত। অর্থাৎ কর্মদক্ষতা থাকলে কাজের অভাব হয় না। বহুমুখি কর্মদক্ষতার মধ্যে বর্তমান কারিগরি দক্ষতার চাহিদা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) একটি দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক প্রতিষ্ঠান, যেখানে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে কর্মমুখি শিক্ষা প্রদান করা হয়। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে কারিগরি শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রসমূহ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের জন্য উপযোগী দক্ষ জনবল তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। দেশকে উন্নত করতে জনগণকে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা প্রয়োজন। বর্তমান বাংলাদেশের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ১১০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। টিটিসি আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ট্রেডে দক্ষতা উন্নয়নবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের আওতায় কম্পিউটার অপারেশন, ট্রেইলারিং এন্ড এমব্রয়ডারি, সুইংমেশিন অপারেশন, মোবাইল ফোন সার্ভিসিং, সোলার ইলেকট্রিক্যাল, অটোক্যাড, কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স, ফ্রুট এন্ড ফুড প্রসেসিং, অটোমেকানিক্স, সিভিল কনস্ট্রাকসন, রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ার কন্ডিশনিং, ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স, রড বাইন্ডারসহ বিভিন্ন টেকনিক্যাল বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে টিটিসির আওতায় এসএসসি ভোকেশনাল ও বিভিন্ন মেয়াদি কারিগরি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে। চাকরি করতে ইচ্ছুক বেকার যুবক ও যুব নারীদের দেশে-বিদেশে আত্ম-কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে দক্ষতার উন্নয়নে কাজ করছে টিটিসি।

 

বর্তমান দেশে-বিদেশে ড্রাইভিং পেশায় চাকরির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। টিটিসি থেকে (২১-৪৫ বছর বয়সি) প্রশিক্ষণার্থী ড্রাইভিং ট্রেডে প্রশিক্ষণ সফলভাবে সম্পন্ন করে সার্টিফিকেটসহ বিনা খরচে সরকারিভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পারেন। প্রতি বছর এদেশের অনেকেই কর্মের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। এসব প্রবাসীর সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষাজ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এজন্য টিটিসি বিভিন্ন দেশের ভাষাগত দক্ষতা উন্নয়ন-বিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা করে।

 

সমাজের বেকার যুবক ও যুব-নারীদের আত্ম-কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসমূহে ফ্রিল্যান্সিং, আইটি সার্পোট, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ওয়েব ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ও ডিজিটাল মার্কেটিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে আউটসোর্সিং-এ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এর ফলে অনেক প্রশিক্ষণার্থীর দেশ-বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে। এছাড়াও এসব প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে যুবক ও যুব-নারীর অনেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজ নিজ উদ্যোগে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপন করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

 

বর্তমান সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের কর্মদক্ষতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। টিটিসি কেন্দ্রসমূহে প্রশিক্ষকগণ প্রশিক্ষণ প্রদানের ক্ষেত্রে যথারীতি নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করেন। ফলে সাধারণ প্রশিক্ষণের তুলনায় এই প্রশিক্ষণ বাস্তবমুখী হয়ে থাকে। টিটিসি থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা কর্মক্ষেত্রে তাদের অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আরও দক্ষ হয়ে উঠেন। এই বর্ধিত দক্ষতা কাজের সন্তুষ্টি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রসমূহ প্রশিক্ষণার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি চতুর্থ শিল্পবিল্পবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম করে তোলে।

 

বাংলাদেশ ক্রমাগত বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এজন্য বিদেশে দিনদিন দক্ষ শ্রমিকের চাহিদাও বাড়ছে। বর্তমান বিশ্বের প্রায় ১৭৪টি দেশে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি কর্মরত। কিন্তু বাংলাদেশি প্রবাসীদের নিকট থেকে প্রত্যাশিত বৈদেশিক মুদ্রা আসছে না। এর অন্যতম কারণ হলো প্রবাসীদের কর্মদক্ষতার অভাব। অদক্ষ শ্রমিকের চেয়ে দক্ষ শ্রমিক প্রায় ১০ গুণ বেশি আয় করেন। শ্রমিকের দক্ষতা নির্ভর করে শিক্ষার মানের ওপর। সাধারণ শিক্ষার দিক থেকে আমরা এগিয়ে থাকলেও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারিনি। তাই গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করা দরকার। অন্যথায় সনদধারী শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার অবনতি ঘটবে। তাই কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়নে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের শিল্প উন্নয়নের সঙ্গে সংগতি রেখে কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থার উন্নয়নও জরুরি। শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেদের আত্ম-কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে, সেজন্য কারিগরি শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হবে। সমাজে সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন মানবসম্পদ উন্নয়ন। শুধু তাই নয়, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে বিবেচনায় রেখে কারিগরি শিক্ষা ও ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

 

 

প্রযুক্তির এই যুগে দেশকে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে প্রয়োজন পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি। এজন্য বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছে। সরকারের একার পক্ষে প্রতিটি পেশার দক্ষতা উন্নয়ন সম্ভব না। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বেসরকারি খাতের সম্পদ, অভিজ্ঞতা ও মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। সরকারি-বেসরকারি সম্মলিত প্রচেষ্টায় দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে যেমন আত্ম-কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে এর সুফল পাওয়া যাবে। এজন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তাহলেই দেশের জনসংখ্যা বোঝা না হয়ে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হবে, এমনটাই সবার প্রত্যাশা। (পি. ফি.)

0 Shares