Home » মতামত » রফিকুল আমীনের ‘আ-আম জনতা পার্টি’: একটি জনভিত্তিহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা -ইঞ্জিনিয়ার সীমান্ত আরিফ

রফিকুল আমীনের ‘আ-আম জনতা পার্টি’: একটি জনভিত্তিহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা -ইঞ্জিনিয়ার সীমান্ত আরিফ

 

রাজনীতি একটি পবিত্র অঙ্গন—যেখানে নেতৃত্ব আসে ত্যাগ, আদর্শ, এবং মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এই ধারাটিতে অনুপ্রবেশ ঘটেছে নানা চরিত্রের, যাদের উদ্দেশ্য আদর্শ নয় বরং ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা। সাম্প্রতিক সময়ে ‘ডেসটিনি’ কেলেঙ্কারির মূল হোতা মোহাম্মদ রফিকুল আমীনের রাজনৈতিক দল গঠন ও সক্রিয় রাজনীতিতে আসার ঘোষণা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিতর্ক ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।

মোহাম্মদ রফিকুল আমীন, এক সময়ের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, যিনি ‘মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম)’ পদ্ধতির নামে গড়ে তুলেছিলেন ডেসটিনি গ্রুপ। তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটি পাহাড়ে গাছ লাগানোর বিনিয়োগ, বহুতল ভবনের মালিকানা বিক্রি, কো-অপারেটিভ সোসাইটি ও প্রফিট শেয়ারিং প্রকল্পের নামে দেশের ২০ লাখের বেশি মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। ২০১২ সালে তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং ও প্রতারণার অভিযোগে মামলা হয় এবং ২০২২ সালে তিনি ১২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। কারাভোগ শেষে তিনি এখন মুক্ত, তবে এই মুক্তি কোনো খালাস নয়—শুধু সাজার মেয়াদ শেষ।

তার রাজনৈতিক দল ‘আ-আম জনতা পার্টি’র আত্মপ্রকাশ প্রশ্ন তোলে—এই রাজনীতির উদ্দেশ্য আসলে কী? একজন দণ্ডপ্রাপ্ত প্রতারক কি আবার রাজনীতির আশ্রয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চান? নাকি আবারো সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার নতুন এক প্ল্যাটফর্ম তৈরির প্রচেষ্টা?

সাংবিধানিকভাবে একজন নাগরিক রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারেন। তবে রাজনৈতিক দলের মূল উদ্দেশ্য যদি হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ, তাহলে সেখানে সাংবিধানিক শর্তও প্রযোজ্য। সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “যদি কোনো ব্যক্তি নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষীসাব্যস্ত হয়ে দুই বছরের বেশি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং মুক্তির পর পাঁচ বছর না পেরোয়, তবে তিনি সংসদ সদস্য হতে পারবেন না।” রফিকুল আমীন ঠিক সেই সীমাবদ্ধতার মধ্যেই পড়েন।

শুধু আইন নয়, নৈতিকতার প্রশ্নও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ তার প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়েছে। কেউ কেউ নিঃস্ব, কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। এমন একজন ব্যক্তি যখন জনতার নেতা হওয়ার দাবিতে এগিয়ে আসেন, তখন রাজনীতির মর্যাদা এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক।

বিশিষ্ট আইনজীবী শিশির মনির, ব্যারিস্টার সানজিদ সিদ্দিকী, এবং এস এম শাহজাহানসহ একাধিক আইনজ্ঞ মত দিয়েছেন—রফিকুল আমীন আইনগতভাবে নির্বাচনের যোগ্য নন। তিনি এখনো অপরাধ থেকে খালাস পাননি, বরং দণ্ড ভোগ করে বের হয়েছেন। এর মানে, তিনি এখনো একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ও নৈতিক স্খলনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি। আদালতের একাধিক রায়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে—যতক্ষণ না তিনি ২৮০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেন, কিংবা খালাস প্রাপ্ত হন, ততক্ষণ তাকে জামিন দেয়া যাবে না। তিনি এই নির্দেশনা অমান্য করেছেন।

তবুও প্রশ্ন থাকে—তার এই রাজনৈতিক উত্থান কি কাকতালীয়, না কি পরিকল্পিত? আইনজীবী আশরাফ রহমান যিনি নিজেও ডেসটিনির প্রতারিত গ্রাহক, সঠিকভাবে লক্ষ করেছেন, “এমন ব্যক্তিরা রাজনীতিকে ব্যবসায়িক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চান, যেন কেউ তাদের বিচার করতে না পারে।” এই উপলব্ধি নিছক আবেগ নয়; এটি বাস্তব প্রেক্ষাপট ও অভিজ্ঞতার ফসল।

রফিকুল আমীন বা তার মতো অন্য যারা বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করে, দেশে বা বিদেশে পাচার করে, পরে রাজনৈতিক দলের ব্যানারে আত্মপ্রকাশ করেন—তারা আসলে গণতন্ত্রের উপর চরম আঘাত করেন। তারা জনমতের নামে নিজস্ব স্বার্থ হাসিল করতে চান। জনগণের ন্যায্য অধিকার ও ভোটের মর্যাদাকে নিজের অপরাধ ঢাকার উপায় বানাতে চান।

এখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি এমন বিতর্কিত চরিত্র রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ পায়, তাতে সাধারণ মানুষ রাজনীতির প্রতি আস্থা হারায়। সৎ ও আদর্শবান নাগরিকরা রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। অপরাধীচক্র এই শূন্যস্থান পূরণ করে। এভাবেই দুর্নীতি, নৈতিক অবক্ষয়, এবং সামাজিক অব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।

এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে, আইন প্রয়োগে কঠোরতা অবলম্বন করা। শুধু কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবেও সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ কার্যকর হওয়া দরকার। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের উচিত—এই ধরনের বিতর্কিত ব্যক্তি বা দলকে নিবন্ধন না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া।

রফিকুল আমীন যদি প্রকৃতপক্ষে জনসেবার জন্য রাজনীতি করতে চান, তবে তার উচিত হবে সর্বপ্রথম ক্ষতিগ্রস্তদের অর্থ ফেরত দেয়া। জনগণের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে নেয়া টাকা ফেরত না দিয়ে, সাজার মেয়াদ শেষ করে রাজনীতিতে ঢুকা ন্যায়বোধ ও মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি যদি সত্যিই নির্দোষ—তাহলে উচ্চ আদালত থেকে খালাস পান, জনগণ সেটি জানুক। তারপরই তিনি নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতা নিয়ে রাজনীতিতে অংশ নিতে পারেন।

শেষ কথা হলো, রাজনীতি কোনো আশ্রয়স্থল নয় অপরাধীদের জন্য। এটি একটি মহান দায়িত্ব, যেখানে নেতৃত্বের মানদণ্ড হতে হবে সততা, জবাবদিহি ও আদর্শিক দায়বদ্ধতা। রফিকুল আমীনের মতো ব্যক্তিদের পুনরায় জনমতের নামে প্রতারণার সুযোগ দেয়া মানেই জনগণের সঙ্গে তামাশা করা। রাষ্ট্র যদি এই তামাশা বন্ধ না করে, তবে ভবিষ্যতের জন্য এর চেয়ে বড় বিপদ আর কিছু হতে পারে না।

এমফিল গবেষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

0 Shares