সামসময়িক সময়ে বিশেষত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের কথাটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। দেশ একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত পার করছে। সব জায়গা থেকেই রাষ্ট্র সংস্কারের কথা উঠছে। যখন একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল হয়ে যায়, সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহির অভাব পরিলক্ষিত হয়, সুশাসন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়, মানবিক মূল্যবোধ খুব একটা নজরে পড়ে না, নীতি-আদর্শ লোপ হয়ে যায়, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামো সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, ঠিক তখনই রাষ্ট্র মেরামত তথা রাষ্ট্র সংস্কার জরুরি হয়ে পড়ে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয় হিসেবে জরুরি যে বিষয়টি সামনে এসেছে তা হলো সংস্কার। ইতোমধ্যে নির্বাচনব্যবস্থা, সংবিধান, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, পুলিশ, জনপ্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সমূহের সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশন কাজ করে যাচ্ছে।
রাষ্ট্রযন্ত্র মেরামত তথা রাষ্ট্রের সংস্কারের কাজ চলছে। এখন কথা হচ্ছে অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাজ হচ্ছে যথাসম্ভব যৌক্তিক সময়ের মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কার শেষে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, বৈষম্যহীন, জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থায় একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করা। এক্ষেত্রে একটি বিষয় গুরুত্বের সাথে লক্ষণীয় যে, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে যারা ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনা করবেন তারা হচ্ছেন রাজনীতিবিদ। আর জনসাধারণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। যারা ভোট দেবেন অর্থাৎ ভোটার এবং যারা নির্বাচিত হবেন অর্থাৎ রাজনীতিবিদ; তারা যদি তাদের চরিত্র না বদলান তবে সংস্কারের ফলাফল সুদূরপ্রসারী অর্থাৎ টেকসই হবে না। কোটা সংস্কার পরবর্তীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রধান কারণ হচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা। ন্যায় ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন তখনই সম্ভব যখন এ রাষ্ট্রের জনগণ সচেতন হয়, সুশিক্ষিত হয়, সর্বোপরি উত্তম চরিত্র বিশিষ্ট মানবিক মানুষ হয়। আর এই মানবিক মানুষ গড়ে তুলতে যে প্রতিষ্ঠানটি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে তা হচ্ছে পাঠাগার। পাঠাগার প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সভ্যতা বিকাশে পাঠাগারের ভূমিকা, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে পাঠাগারের কার্যকারিতা, উন্নত চরিত্র গঠন থেকে শুরু করে উন্নত রাষ্ট্র গঠনে পাঠাগার কীভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে তা পর্যালোচনা করলেই রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগারের ভূমিকা বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
রাষ্ট্র সংস্কারের পাঠাগার কেন একটি বিবেচ্য বিষয় তা অনুধাবনের জন্য নিকট অতীতের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরা দরকার। জনগণের ভোটে নয় অন্য কোন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় যখন কোনো সরকার ক্ষমতায় আসে তখন সেই সরকার জনগণের উপর কর্তৃত্ববাদী ও অত্যাচারী হয়ে উঠে, কারণ জনগণের কাছে তার কোনো জবাবদিহিতা থাকে না। ফলে অগণতান্ত্রিকভাবে সরকার তার ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে থাকে। সরকারের নিবর্তনমূলক আচরণ এবং জনগণের চাহিদা অনুযায়ী বিরাজমান বিরোধীদল সরকার বিরোধী কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে না। এমতাবস্থায় অস্বচ্ছ/অগণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকার এবং দুর্বল বিরোধীদল উভয়ের কাছেই সাধারণ জনগণ উপেক্ষিত। কারণ সরকার ও বিরোধীদল শুধু ক্ষমতার জন্যেই রাজনীতি করে। উভয় পক্ষের কেহই জন-আকাঙ্ক্ষা অনুধাবন করে না। দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে গঠিত সরকার প্রায় সময়ই জনগণের উপর ক্ষমতা প্রয়োগে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা রাখে। রাষ্ট্রে এধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তখনই ঘটে যখন ভোটার তথা সাধারণ জনতা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ কমে যায়। বিশেষ করে শাসকগোষ্ঠী সুশাসন, নীতিবোধ এবং ন্যায় পরায়ণতা রাষ্ট্র পরিচালনায় উপেক্ষিত করে। একচ্ছত্র ক্ষমতা শাসকগোষ্ঠীকে স্বৈরশাসকে রুপান্তর করে। সুশিক্ষায় পিছিয়ে থাকা রাষ্ট্রসমূহে বিরোধীদলের শ্রেণিচরিত্র শাসকগোষ্ঠীর শ্রেণিচরিত্রের চেয়ে খুব বেশি উন্নত হয় না। কল্যাণরাষ্ট্র গড়ে তুলতে দেশের রাজনৈতিক দলসমূহের সদস্যসহ দেশের নাগরিক শ্রেণিকে সুশিক্ষিত ও সচেতন করে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। আর জনগণকে সু-শিক্ষিত ও সচেতন করে গড়ে তুলতে পাঠাগার মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
আলোচ্য বিষয় অর্থাৎ ‘রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগার’ সম্পর্কে আলোকপাত করতে গেলে পাঠাগার এবং সভ্যতার বিকাশে পাঠাগারের ভূমিকা প্রসঙ্গে দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক। পাঠাগার এবং সভ্যতা বিকাশে পাঠাগারের ভূমিকা আমরা জানি বইয়ের শ্রেণিবদ্ধ সংগ্রহই হচ্ছে পাঠাগার, যেখানে বই এবং পাঠকের মিলন ঘটে। পাঠাগারের মূল উপাদান হচ্ছে ‘বই’; এটি এমন একটি শব্দ যার ভেতরে লুকিয়ে আছে হাজারো জ্ঞানের ভাণ্ডার। পাঠাগার হচ্ছে বই ও অন্যান্য তথ্য সামগ্রীর একটি সংগ্রহমালা, পাঠক যেখানে তার পছন্দের বই পাঠ করে, তথ্যানুসন্ধান করে এবং গবেষণাও করতে পারে। জীবনের সফলতা অর্জনের জন্য একজন মানুষের যে-সকল গুণাবলি বা দক্ষতার প্রয়োজন হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বই পড়া। তাই বলা চলে পাঠাগার হচ্ছে সমাজ তথা রাষ্ট্রের বাতিঘর। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জীবন প্রবাহ চালু রাখছে এই পাঠাগার। মানুষের বই পড়ার আগ্রহ থেকেই পাঠাগারের সৃষ্টি। মানুষের মননশীল, চিন্তাশীল ও সৃষ্টিশীল কাজের কারিগর হচ্ছে পাঠাগার।
সভ্যতার বিকাশের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে পাঠাগার। পাঠাগার শুধু জ্ঞান ও তথ্যভাণ্ডার হিসেবে কাজ করেনি, বরং সভ্যতার অগ্রগতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। পাঠাগারের ইতিহাস অনেক পুরোনো। পাঠাগার সৃষ্টি হয়, পাঠাগার এগিয়ে যায়। দেখা যায় পাঠাগারের সাথে সাথে যেন সভ্যতা, সংস্কৃতি, জাতীয় উন্নতি, রাষ্ট্রের উন্নয়ন একসূত্রে গাঁথা। যে জাতির পাঠাগারের ইতিহাস সমৃদ্ধ, সে জাতি তত উন্নত। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিশর ও গ্রীসের পাঠাগারসমূহ সেসব দেশের সভ্যতা বিকাশে কীভাবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে আলেকজান্দ্রিয়ায় বিখ্যাত পাঠাগার যা প্রাচীন বিশ্বে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। আনুমানিক ১১২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ট্রাজান রোম শহরে ট্রাজান ফোরাম লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের কনস্টান্টিনোপল ঐতিহাসিক ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয় । আব্বাসীয়দের শাসনামলে খ্রিস্ট্রীয় নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে ইরাকের বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হয় হাউজ অব উইজডম নামে বিখ্যাত পাঠাগার। বিশ্ববিখ্যাত পাঠাগারের মধ্যে ব্রিটিশ মিউজিয়াম, মস্কোর লেলিন লাইব্রেরি, ফ্রান্সের বিবলিওথিক নাসিওনাল লাইব্রেরি, ওয়াশিংটনের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশে ঢাকার কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি (১৯৫৩ সনে প্রতিষ্ঠিত) দেশের একটি স্বনামধন্য লাইব্রেরি। মধ্যযুগেও পাঠাগারসমূহ জ্ঞান, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে কাজ করেছে। ইউরোপের বিভিন্ন মঠ ও মসজিদে স্থাপিত পাঠাগারগুলোতে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও দর্শনের চর্চা হত। ইসলামি জাগরণের স্বর্ণযুগে বাগদাদে বায়তুল হিকমাহ জ্ঞান ও গবেষণার এক অভূতপূর্ব মিলনকেন্দ্র হিসেবে তৎকালীন সবার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বায়তুল হিকমা বিশ্বে বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছিল। বর্তমান সময়েও সারাবিশ্বে পাঠাগার জ্ঞানের মশাল হিসেবে জ্ঞান বিতরণ করে মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় বলা যায় যে, পাঠাগার একটি জাতির বিকাশ ও উন্নতির মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়।
গণতন্ত্রের চর্চা করতে, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন করতে, উন্নত জীবন ব্যবস্থা, রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা তথা জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে, ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে। কিন্তু রাষ্ট্রের মানুষের সংস্কার না হলে রাষ্ট্র সংস্কার টেকসই হবে না। দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিবর্গের চরিত্র সংশোধন অতীব জরুরি মর্মে তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করেন। সেই সাথে জনগণ যাতে তাদের অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয় এবং সাময়িক লোভের বশবর্তী না হয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে তাদের নেতা হিসেবে বেছে নেয়, সে লক্ষ্যে জনগণকে যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। আর জনগণকে সেই পর্যায়ের যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পাঠাগারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
পাঠাগার সমাজ তথা রাষ্ট্র উন্নয়নের বাহন। একটি জাতির মেধা, মনন, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারণ ও লালন-পালনকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পাঠাগার। শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষ উন্নয়নমনস্ক হয়। পাঠাগার শিক্ষার আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে । বই পড়ার মাধ্যমে একজন মানুষ নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে পারে। আর এই পরিশুদ্ধ মানুষ তৈরি হলে তবেই কার্যকরভাবে রাষ্ট্র সংস্কার সম্ভব। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষই রাষ্ট্র সংস্কার করতে পারে এবং সেই সংস্কার ধরে রাখতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। পাঠাগার একটি জাতির বিকাশ ও উন্নতির মাপকাঠি। পাঠাগারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে উন্নত চিন্তা-চেতনা গড়ে ওঠে, মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয় এবং অধিকার আদায় ও তা রক্ষার উপায় বের হয়। যা মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে সংহতি, সৌহার্দ্য এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। মূল্যবোধ সম্পন্ন সচেতন মানুষ রাষ্ট্র সংস্কার করতে এবং সেই সংস্কার ধরে রাখতে কার্যকর ভূমিকাও পালন করতে সক্ষম হয়। আর উন্নত চরিত্র সম্বলিত সচেতন মানুষ গঠনে পাঠাগার যে অনন্য ভূমিকা পালন করে তা সর্বজনস্বীকৃত।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
-পি. ফি.