Home » সারাদেশ » শিকারিদের ভয়ে কমে যাচ্ছে সুনামগঞ্জের টাক্সগুয়ার হাওরে পরিযায়ী পাখির আগমন

শিকারিদের ভয়ে কমে যাচ্ছে সুনামগঞ্জের টাক্সগুয়ার হাওরে পরিযায়ী পাখির আগমন

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধিঃ-
পরিযায়ী পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে দেশ-বিদেশে পরিচিত ও ইউনেস্কোর ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য, বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলায় অবস্থিত টাক্সগুয়ার হাওর। প্রতি বছর শীত মৌসুমে সুদূর সাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি আসতো হাওরটিতে। এক সময় পাখির কলকাকলিতে টাক্সগুয়ার হাওরের আশপাশের এলাকা উজ্জীবিত হয়ে উঠতো শীত মৌসুমে। দিনের বেলা টাক্সগুয়ার হাওর সহ আশপাশের কয়েকটি হাওরেও পাখি উড়তে দেখা যেত। তবে প্রতি বছর হাওরটিতে পাখি আসার সংখ্যা কমে আসছে। এবছর পৌষ মাসের মাঝামাঝি সময়ে কিছু পাখির দেখা মিলেছে। তবে পাখি আসার সাথে সাথে বেড়েছে পাখি শিকারিদের উৎপাত। হাওরে পাখি কমে যাওয়ার পিছনে স্থানীয় পাখি শিকারিদের দায়ি করছেন এলাকাবাসী। খোঁজ নিয়ে জানাযায়, প্রতি বছর টাক্সগুয়ার হাওরে পরিযায়ী পাখি শিকারের জন্য কিছু সংখ্যক স্থানীয় শিকারি বিভিন্ন ভাবে ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করে আসছে। এসব শিকারকৃত পাখি এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে গোপনে বিক্রি করে। এদের মধ্যে একদল শিকার করে আরেক দল বিক্রি করে। তবে পাখির মাংস সুস্বাদু ও দাম বেশি হওয়ার উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সচেতন লোকেরাই ক্রয় করেন বলেও জানা গেছে। ক্রেতাদের তালিকায় সরকারি বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীও রয়েছেন। শীত মৌসুমে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারের খাবারের মেনুতে পাখির মাংস পাওয়া যায়। এমনকি পাখি ক্রয় করে এলাকার বাইরে অবস্থানরত আত্মীয় স্বজন ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আবদার পূরণ করেন হাওর পাড়ের এক শ্রেণির সচেতন লোক। গত বছর থেকে অনলাইনে পাখির মাংস বিক্রির কথাও জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সম্প্রতি, উপজেলার শ্রীপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামের মুজিবুর রহমানের ছেলে দেলোয়ার হোসেন নামে এক শিকারি পাখি শিকার করে বিক্রির জন্য ফেসবুকে লাইভ করেছে। এরপরে হাওরে অভিযান পরিচালনা করে দুই পাখি শিকারিকে আটক করে জেলে দেয় উপজেলা প্রশাসন।
টাক্সগুয়ার হাওর পাড়ের পরিবেশ কর্মি ও সংবাদকর্মি আহমদ কবির জানান, চলতি পৌষ মাসের মাঝামাঝি সময়ে হাওরে পাখি আসা শুরু করেছে। তবে গত বছরের তুলনায় এবার অনেক কম। প্রতি বছরেই কমছে পরিযায়ী পাখির আগমন। এর কারন হচ্ছে- হাওরের পাখির অভয়াশ্রম লেচুয়ামারা বিলের আশপাশ ও তেকুইন্যা বেরবেরিয়া বিল এলালায় পাখি শিকারিরা উচ্চক্ষমতার টর্চলাইট, বিষটোপ ও সুতার ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করে। এমনকি দিনের বেলা বিভিন্ন হাওরে ঘুরতে গেলেও শিকারিদের হাতে শিকার হয় পাখি। স্থানীয় এক পাখি বিক্রেতার সাথে প্রতিবেদকের কথা হয়। এসময় পাখি বিক্রেতা জানায়, আমি শুধু শিকারিদের কাছ থেকে পাখি কিনে বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি করি। এর মধ্যে সরকারি বেসরকারি কিছু অফিসার, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সচেতন লোকেরই পাখি কিনে থাকেন। সিএনআরএস এর উপজেলা সমন্বয়কারী ইয়াহিয়া সাজ্জাদ বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে বিদেশি প্রজাতির পাখির আসা কমে গেছে। এর প্রধান কারণ পাখি শিকার। পাখি যদি বুঝতে পারে জায়গাটি তাদের জন্য নিরাপদ নয়, তাহলে সেখানে আর আসে না। এভাবেই বহুপ্রজাতির পাখি এখন কালেভদ্রে ও দেখা যায় না। টাক্সগুয়ার হাওর পাড়ের মন্দিয়াতা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সানজু মিয়া বলেন, ছোট থাকতে শীতে টাক্সগুয়ার হাওরে আসা পরিযায়ী পাখির কোলাহলে আমাদের ঘুম ভাঙত। তবে কয়েক বছর ধরে আর আগের মতো অতিথি পাখি আসে না। আমরা চাই টাক্সগুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য গড়ে উঠুক। জানাযায়, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে প্রতি বছর শীত প্রধান দেশ সুদূর সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীন, নেপালসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এক সময় প্রায় ২১৯ প্রজাতির পাখি আসতো। এর মধ্যে ৯৮ প্রজাতি পরিযায়ী, ১২১ প্রজাতির দেশি ও ২২ প্রজাতির হাঁসজাত পাখি বিচরণ করত এই টাক্সগুয়ার হাওরে। পাখিশুমারী করে বার্ডস ক্লাব এর তথ্যমতে, গতবছর ৪৯ প্রজাতির ৪৩ হাজার ৫১৬ টি পরিযায়ী পাখি এসেছিল টাক্সগুয়ার হাওরে। এ বছর জানুয়ারির শুরুতে এসে হাওরে পাখি আসতে দেখা গেছে। তবে গতবছরের তুলনায় অনেক কম। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্যা কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) টাক্সগুয়ার হাওরে জীব-বৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। সংস্থাটি টাক্সগুয়ার হাওরের তেকুইন্যা বেরবেরিয়া বিল ও লেচুয়ামারা বিল নামের দুইটি জলাশয় পরিযায়ী ও দেশীয় পাখির অভয়াশ্রম নির্ধারণ করে কোর জোনের আওতাভুক্ত করেছে। প্রতি বছর টাক্সগুয়ার হাওরে আসা পাখি দিনের বেলায় হাওরজুড়ে বিচরণ করলেও সন্ধ্যায় বেরবেরিয়া বিল ও লেচুয়ামারা বিলে এসে নির্ভয়ে আশ্রয় নিয়ে থাকে। পরিযায়ী পাখি মূলত তীব্র শীত ও খাদ্যাভাব থেকে বাঁচতে হাজার হাজার মাইল দূরের পথ উড়ে টাক্সগুয়ার হাওরে আসে। ওরা আসতে শুরু করে নভেম্বরে। এপ্রিল পর্যন্ত থাকে। এবার প্রায় একমাস দেরিতে টাক্সগুয়ার হাওরে এলো পরিযায়ী পাখি। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্যা কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এর মূখ্য গবেষক ও লেখক সীমান্ত দীপু বলেন, বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে টাক্সগুয়ার হাওর পাখির জন্য নিরাপদ। এই হাওরে দেশে পরিযায়ী পাখির সবচেয়ে বড় সমাবেশ ঘটে। মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেখানে পরিযায়ী পাখি আসতে থাকবে। তবে টাক্সগুয়ার হাওর এলাকায় পাখি শিকারি ও পর্যটকরা পাখি নিরাপদে থাকার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ান। তাই টাক্সগুয়াকে পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তুলতে স্থানীয় জনগণসহ প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে। তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল হাসেম জানান, টাক্সগুয়ার হাওরে পাখি শিকার বন্ধে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ এলাকায় পাখি শিকারের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে দুইজন শিকারিকে মামলা দিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। যে কেউ পাখি শিকারে জড়িত প্রমাণ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

0 Shares