ইসলাম যে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো হজ। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলিম নর-নারীর ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। এটি মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। হজ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো সংকল্প করা, সফর করা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট কার্যাবলির মাধ্যমে বায়তুল্লাহ শরীফ জেয়ারত করাকে হজ বলা হয়। হজ ফরজ ইবাদত। পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রত্যেক সামর্থ্যবান মানুষের ওপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ করা ফরজ’ (সুরা আলে ইমরান: ৯৭)।
হজ ফরজ হওয়ার পাঁচটি শর্ত আছে। যথা: ১) মুসলিম হওয়া ২) বিবেকবান হওয়া অর্থাৎ পাগল না হওয়া ৩) প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া ৪) স্বাধীন হওয়া অর্থাৎ কারো গোলাম না হওয়া এবং ৫) দৈহিক ও আর্থিক সক্ষমতা থাকা। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে আরেকটি শর্ত রয়েছে, সেটি হলো- মাহরাম তথা যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাতের বিধান আছে এরূপ পুরুষ থাকা।
হজব্রত পালন অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। হাদিসে হজকে উত্তম আমল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সহীহ্ বোখারী শরীফে বর্ণিত আছে- একবার রাসুল (স.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি ঈমান আনা। প্রশ্ন করা হলো, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। পুনরায় প্রশ্ন করা হলো, এরপর কোনটি? তিনি বললেন, হজে মাবরুর তথা মকবুল হজ।(বুখারি: ১৫১৯)।
হাদিসে হজ পালনকারীদেরকে গুনাহ মাফের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। রাসুল (স.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ করল এবং এসময় অশ্লীল ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকল, সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে।’ ( সহীহ বুখারি: ১৫২১)। অন্য এক হাদিসে কবুল হজের প্রতিদান হিসেবে জান্নাতের কথা বলা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, এক উমরাহ আরেক উমরাহ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহর ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়। আর কবুল হজের প্রতিদান তো বেহেশত ছাড়া আর কিছুই নয়। (সহিহ বুখারি: ১৭৭৩; সহিহ মুসলিম: ১৩৪৯) । হজের বিধান ফরজ হওয়ার পাশাপাশি এর অত্যধিক গুরুত্ব ও ফজিলতের কারণে প্রত্যেক ইমানদার মুসলমানের মধ্যেই হজব্রত পালনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকে। এছাড়া, যে কিবলাহর দিকে ফিরে মুসলমানগণ দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে থাকেন সেই কিবলাহকে দুনয়নে দেখা, হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করা, হারামাইন শরীফ, মসজিদে নববী ও বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ (স) স্মৃতিবিজড়িত জন্মভূমির ঐতিহাসিক স্থানসমূহ নয়নভরে দেখার ব্যাকুলতাও সকল মুসলমানকে হজ পালনে বিশেষভাবে আগ্রহী করে তোলে।
বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। বর্তমানে দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৯৩ শতাংশই মুসলমান। হজযাত্রী প্রেরণের সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। বিগত ১০ বছরের হজযাত্রীদের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় ২০২৪ সালে হজযাত্রীদের সংখ্যা কিছুটা কম হলেও বাকি বছরগুলোতে দেশ থেকে লক্ষাধিক হজযাত্রী হজব্রত পালন করেছেন। একক বছর হিসেবে ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি ১ লাখ ২৭ হাজার ২৯৮ জন ব্যক্তি বাংলাদেশ থেকে হজব্রত পালন করেন।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে কর্মবণ্টন(সংশোধিত ২০১৪ পর্যন্ত) অনুসারে হজ নীতি ও হজ প্যাকেজ ঘোষণা, দ্বিপাক্ষিক হজ চুক্তি স্বাক্ষর, হজযাত্রীদের আবাসন ব্যবস্থাপনা এবং হজ ও উমরাহ সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়গুলো সম্পাদনের দায়িত্ব ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত। এসংক্রান্ত সকল দায়িত্ব পালনে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সদা তৎপর।
হজ ব্যবস্থাপনা একটি সময়াবদ্ধ কাজ; সংবেদনশীলও বটে। সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ কঠোরভাবে অনুসরণ করেই হজ ব্যবস্থাপনা সম্পাদন করতে হয়। এক্ষেত্রে শিথিলতা দেখানোর অবকাশ নেই। সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনার জন্য ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৌদি সরকার ঘোষিত রোডম্যাপ অনুসরণ করে যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পাদন করে থাকে। একটি হজ সম্পন্ন হওয়ার অব্যবহিত পরেই পরবর্তী বছরের হজের কার্যক্রম শুরু হয়। হজ ব্যবস্থাপনার প্রথম ধাপটিই হলো হজযাত্রী প্রাক-নিবন্ধন ও প্রাথমিক নিবন্ধন। হজব্রত পালনে ইচ্ছুক ব্যক্তিগণকে সরকার নির্ধারিত টাকা জমা দিয়ে অনলাইনে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে গিয়ে ঘোষিত সময়ের মধ্যে প্রাক-নিবন্ধন ও প্রাথমিক নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হয়। এসময়ে জমাকৃত টাকা নির্বাচিত হজ প্যাকেজের সাথে সমন্বয় করা হয়ে থাকে। এই টাকা কোনোভাবেই হজ প্যাকেজের অতিরিক্ত নয়। এবার প্রাক-নিবন্ধনের জন্য ৩০ হাজার এবং প্রাথমিক নিবন্ধনের জন্য তিন লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হজ প্যাকেজ মূল্য কমানোর বিষয়ে মুসলমানদের দাবি রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে হজের খরচ কমানোর বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ধর্ম উপদেষ্টা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে হজের সাথে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সাথে বেশ কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ধর্ম উপদেষ্টার নেতৃত্বে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দল সৌদি আরব সফর করেছেন। এ সফরে তাঁরা সেদেশের হজ ও উমরাহ্ মন্ত্রী ড. তৌফিক ফাউযান আল রাবিয়াহের সাথে দ্বিপক্ষীয় সভা করেছেন। হজ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী কোম্পানির সাথেও মতবিনিময় করেছেন। এছাড়া, মক্কা ও মদিনায় হজযাত্রীদের আবাসন উপযোগী হোটেল পরিদর্শন করেছেন।
হজ প্যাকেজ ঘোষণা হজ ব্যবস্থাপনার অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। হজব্রত পালনে কী পরিমাণ টাকা প্রয়োজন সেটাই মূলত খাতভিত্তিক হিসেব কষে হজ প্যাকেজ চূড়ান্ত করা হয়ে থাকে। সৌদিতে যাতায়াতের বিমানভাড়া, মক্কা ও মদিনার হোটেল ভাড়া, মীনা, আরাফাহ ও মুজদালিফায় আবাসন, খাবার-দাবার, সৌদি আরব প্রান্তের পরিবহণ, ভিসা ফি, স্বাস্থ্যবিমা, হজ গাইড, জমজমের পানি প্রভৃতি ব্যয় নিরূপণ করেই হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ বিমান, সাউদিয়া ও ফ্লাইনাস-এই তিনটি এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের হজযাত্রী পরিবহণ করে। এ তিনটি এয়ারলাইন্সের ভাড়া একই। ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স যৌথভাবে যে বিমান ভাড়া নির্ধারণ করে থাকে সেই ভাড়াতেই অন্য দুটি এয়ারলাইন্স হজযাত্রী পরিবহণ করে। হজযাত্রী পরিবহণে ডেডিকেটেড ফ্লাইট ব্যবহার করতে হয়। ফলে অন্যান্য সময়ে বাংলাদেশ হতে জেদ্দা যেতে যে ভাড়া গুণতে হয় হজযাত্রী পরিবহনে স্বভাবতই তার চেয়ে বেশি ভাড়া গুণতে হবে। গত কয়েক বছর হজযাত্রী পরিবহণে বিমানভাড়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। পাশ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ থেকে বিমান ভাড়া অনেক বেশি বলে পত্র-পত্রিকা কিংবা গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রচার করা হচ্ছে। সকলের দাবি বিমান ভাড়া যৌক্তিক করা হোক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিমান ভাড়া কমানোর পাশাপাশি হজ প্যাকেজ মূল্য যৌক্তিকভাবে নির্ধারণের কথা বলে আসছেন। ইতোমধ্যে বিমান ভাড়া কমানোর বিষয়ে দুটি সভা হয়েছে এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ভাড়া কমানোর বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সর্বশেষ বৈঠকেও বিমান ভাড়া নির্ধারণের বিষয়ে আরো কিছু প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে।
ইতোমধ্যে ২০২৫ সালে সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যেতে দুটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। একটি প্যাকেজে সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্যাকেজে (মসজিদুল হারামের আশপাশের ৩ কিলোমিটারের মধ্যে বাড়ি) ৪ লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ টাকা। অপর প্যাকেজে (মসজিদুল হারামের আশপাশের দেড় কিলোমিটারের মধ্যে বাড়ি) ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০ টাকা। আর বেসরকারিভাবে সাধারণ প্যাকেজে ৪ লাখ ৮৩ হাজার ১৫৬ টাকা।
মক্কায় বাংলাদেশের হজযাত্রীরা হারাম শরীফের সন্নিকটে থাকতে চান। হারাম শরীফের কাছাকাছি হোটেলগুলোর ভাড়া সঙ্গতকারণেই বেশি হয়। কিন্তু ভারত, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার হাজিদেরকে রাখা হয় আজিজিয়া ও তৎসংলগ্ন এলাকায়। হারাম শরীফের দেড় থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে একটি হোটেলের ভাড়া যদি চার হাজার সৌদি রিয়াল হয়, সেই একইমানের হোটেলের ভাড়া আজিজিয়া এলাকায় সর্বোচ্চ ২,৫০০-৩,০০০ রিয়ালের মধ্যে হবে। বাংলাদেশি মুদ্রায় হিসাব করলে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা কম। ঠিক একইভাবে মদিনাতেও মসজিদে নববী হতে দূরত্ব বিবেচনায় হোটেল ভাড়ার তারতম্য হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সরকারি হাজিদেরকে সাধারণত মারকাজিয়া এলাকায় রাখা হয় যেখানে ভাড়া এক হাজার দুই শত রিয়াল কিংবা তার চেয়ে বেশি। মসজিদে নববী হতে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে হোটেল ভাড়া ৭০০-৮০০ রিয়ালের মধ্যে হয়ে থাকে।
বিমান ভাড়া এবং হোটেল ভাড়া এই দুটি খাত ছাড়া অন্যান্য খাতগুলোতে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। তবে হোটেল ভাড়া কমানোর একমাত্র কৌশল হলো হারাম শরীফ থেকে দূরবর্তী স্থানে আবাসনের ব্যবস্থা করা। সাধারণত বাংলাদেশি হাজীদের বয়স, মানসিকতা ও শারীরিক সক্ষমতা বিবেচনায় সরকারি হাজিদেরকে সবসময় হারাম শরীফ হতে এক-দুই কিলোমিটারের মধ্যে রাখা হয়।
বাংলাদেশ হতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যারা হজব্রত পালন করেন তাদের কাছ থেকে ঘোষিত প্যাকেজ মূল্যের বাইরে একটি টাকাও বেশি নেয়া হয় না। সরকারের পক্ষ হতে হাজীদের জন্য প্রায় এক কোটি টাকার ঔষধ, প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার, নার্স, ফার্মাসিস্ট প্রভৃতি দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সরকারি হাজীদের সেবায় হোটেলগুলোতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৩-৪ সদস্যের একটি টিম ও হজকর্মি নিয়োজিত থাকে। এদের খরচও সরকার বহন করে। প্রকৃতপক্ষে, হজব্রত পালনের জন্য যে পরিমাণ টাকা প্রয়োজন সেটা নিরূপণ করেই প্যাকেজ মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এখানে সরকারের কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নেই। এমনকি প্যাকেজ মূল্য হতে কম খরচে হজ সম্পন্ন হলে বাড়তি টাকা হাজিদের ফেরত দেয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে। সরকার কোনো মুনাফা বা লাভের আশায় হজ প্যাকেজ নির্ধারণ করে না, হাজিদের সেবাই সরকারের একমাত্র ব্রত।
-লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়
-পি. ফি.