Home » মতামত » সরকারের উন্নয়ন বার্তা প্রচারে জেলা তথ্য অফিসের ভূমিকা -মো. মামুন অর রশিদ

সরকারের উন্নয়ন বার্তা প্রচারে জেলা তথ্য অফিসের ভূমিকা -মো. মামুন অর রশিদ

 

তথ্যই শক্তি। কথাটি বহুলপ্রচলিত ও তাৎপর্যপূর্ণ। তথ্য তখনই শক্তি হয়ে ওঠে, যখন তথ্য দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়। যিনি তথ্যকে ব্যবহার করতে জানেন না, তার কাছে তথ্যকে গ্রন্থগত বিদ্যা কিংবা পরহস্তে ধনের মতো অর্থহীন মনে হতে পারে। তথ্যের সৌন্দর্য প্রচারে। তথ্য যত বেশি প্রচারিত হবে, মানুষ তত বেশি সচেতন ও বুদ্ধিদীপ্ত হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখনো তথ্য সাক্ষরতার বাইরে রয়েছে। পিছিয়ে থাকা এই জনগোষ্ঠীকে তথ্যসেবার মাধ্যমে সচেতন, উদ্‌বুদ্ধ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার জন্য সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তর হলো জেলা তথ্য অফিস। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের অধীন জেলা তথ্য অফিসসমূহ মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন জনপ্রিয় প্রচারকৌশলের মাধ্যমে সরকারের উন্নয়ন বার্তা জনগণের নিকট পৌঁছে দিচ্ছে।

এ অঞ্চলে মাঠ প্রচারের ইতিহাস বেশ পুরাতন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার প্রচার বিভাগের গুরুত্ব অনুধাবন করে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বার্তা জনগণের নিকট পৌঁছে দেয়া এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও স্যানিটেশন বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত ভারতে সর্বপ্রথম প্রচার বিভাগ নামে একটি বিভাগ চালু করে। কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে এ বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। এই প্রচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। কবি জসিম উদদীন, প্রখ্যাত সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহ্‌মদ-সহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি প্রচার বিভাগে কাজ করেছেন। ব্রিটিশ ভারতের পাবলিসিটি অফিস এবং পাকিস্তান আমলের জেলা ও মহকুমা জনসংযোগ অফিসের উত্তরসূরি হলো আজকের জেলা তথ্য অফিস।

মাঠ পর্যায়ে প্রচার কার্যক্রম বাস্তবায়নে জেলা তথ্য অফিস বহুমুখী প্রচারকৌশল ব্যবহার করে। জেলা তথ্য অফিসের একটি কার্যকর প্রচারকৌশল হলো পথ প্রচার। জেলা তথ্য অফিস সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি, জরুরি বিজ্ঞপ্তি ও সরকারের জনগুরুত্বপূর্ণ বার্তা জনগণকে অবহিত করতে সড়ক প্রচারের (মাইকিং) ব্যবস্থা করে। সরকারের যেকোনো জরুরি বার্তা পাওয়া মাত্রই জেলা তথ্য অফিসের ঘোষক ও কর্মচারীবৃন্দ প্রচার কাজে বেরিয়ে পড়েন। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা-সহ যেকোনো দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে জেলা তথ্য অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ অনেক ঝুঁকি নিয়ে জনগণের নিকট জরুরি বার্তা পৌঁছে দেন। আবার জেলার কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে কিংবা কোথাও ১৪৪ ধারা জারি করা হলে জেলা তথ্য অফিস সংশ্লিষ্ট এলাকায় জরুরি বার্তা প্রচার করে। বাংলাদেশের উপকূলীয় ও নদীর তীরবর্তী এলাকার মানুষকে সচেতন করতে জেলা তথ্য অফিস লঞ্চ ও নৌকার মাধ্যমেও বার্তা প্রচার করে।

জেলা তথ্য অফিসের আরেকটি প্রচারকৌশল হলো প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী। গ্রামাঞ্চলে এটি বায়োস্কোপ নামে বহুলপরিচিত। জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জেলা তথ্য অফিসের উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও জনবহুল স্থানে বড়ো পর্দায় প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এসব প্রদর্শনীতে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আর্থসামাজিক বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগেও বড়ো পর্দায় প্রদর্শিত প্রামাণ্যচিত্রের প্রতি মানুষের বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে।

জেলা তথ্য অফিসের একটি ভিন্নধর্মি প্রচারকৌশল হলো নারী সমাবেশ। গ্রামীণ অনগ্রসর নারীদের সচেতন ও উদ্‌বুদ্ধ করতে জেলা তথ্য অফিস তৃণমূল পর্যায়ে নারী সমাবেশের আয়োজন করে। এসব নারী সমাবেশে নারী উন্নয়ন নীতিমালা, নারীদের উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগ, নারীর ক্ষমতায়ন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে করণীয়, নারীদের আত্মকর্মসংস্থান ও নারীর জীবনমান উন্নয়ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। এ ছাড়া নারী সমাবেশে সফল নারীদের জীবন সংগ্রামের গল্প তুলে ধরার মাধ্যমে নারীদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে উদ্‌বুদ্ধ করা হয়। নারীসমাজকে সচেতন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে জেলা তথ্য অফিসের নারী সমাবেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।

জেলা তথ্য অফিস আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের মাধ্যমেও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা জনগণের নিকট পৌঁছে দিচ্ছে। জেলা তথ্য অফিসের একটি আন্তঃব্যক্তিক প্রচারকৌশল হলো আলোচনাসভা। সরকারের নীতি, সাফল্য ও উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে অবহিত, সচেতন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে জেলা তথ্য অফিস আলোচনাসভার আয়োজন করে থাকে। বৃহৎ পরিসরে এই আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়। এ ধরনের সভায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাগণকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আলোচনাসভায় জনগণকে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদানের পাশাপাশি স্থানীয় বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে করণীয় বিষয়েও আলোচনা করা হয়।

জেলা তথ্য অফিসের আরেকটি কার্যকর আন্তঃব্যক্তিক প্রচারকৌশল হলো উঠান বৈঠক। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়ির উঠানে স্বল্প পরিসরে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে উঠান বৈঠক আয়োজন করা হয়। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে সরকারি বিভিন্ন সেবা ও জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয় সম্পর্কে স্থানীয় জনগণকে অবহিত করা হয়। জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে এসব উঠান বৈঠক কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।

জেলা তথ্য অফিস উদ্‌বুদ্ধকরণ সংগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমেও বার্তা প্রচার করে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নিকট এখনোও সংগীতের ব্যাপক আবেদন রয়েছে। জেলা তথ্য অফিসে নিয়োজিত পাঁচ জন খণ্ডকালীন শিল্পী জেলার শহর, বস্তি, হাট-বাজার ও গ্রামাঞ্চলে সংগীত পরিবেশন করেন। সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে গানে গানে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্যানিটেশন-সহ জাতি গঠনমূলক বিষয় সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা হয়।

এ ছাড়া জেলা তথ্য অফিস মতবিনিময় সভা, কর্মশালা, কমিউনিটি সভা, শিশুমেলা আয়োজন-সহ বিভিন্ন ধরনের প্রচারকৌশল বাস্তবায়ন করছে। জেলা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে শব্দযন্ত্র স্থাপনের দায়িত্বও পালন করছে জেলা তথ্য অফিস। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জেলা তথ্য অফিসের প্রচারকৌশলে এসেছে নতুনত্ব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব-এর মাধ্যমেও জেলা তথ্য অফিস প্রচার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

মাঠ পর্যায়ে সরকারের একমাত্র প্রচার প্রতিষ্ঠান হলো জেলা তথ্য অফিস। সরকারের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাঠ পর্যায়ে প্রচার পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে জেলা তথ্য অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ নিরলসভাবে কাজ করছে। প্রচার কার্যক্রম বাস্তবায়নের পাশাপাশি জেলা তথ্য অফিস সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণের প্রতিক্রিয়া সরকারের নিকট পৌঁছে দিচ্ছে। এভাবে জেলা তথ্য অফিস সরকার ও জনগণের মধ্যে তথ্যের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করছে। (পি. ফি.)

লেখক : বিসিএস তথ্য ক্যাডার কর্মকর্তা ও সিনিয়র তথ্য অফিসার পদে আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর-এ কর্মরত

0 Shares