Home » মতামত » সামাজিক নিরাপত্তা কল্যাণকর রাষ্ট্র -মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন

সামাজিক নিরাপত্তা কল্যাণকর রাষ্ট্র -মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন

স্বাধীনতার ৫৩বছর পর ২০২৪ সালে আরেকটি স্বাধীনতার স্বাদ পেল জাতি।আন্দোলন-সংগ্রাম ও সহস্র তরতাজা ছাত্র-ছাত্রী/শিশু গৃহবধূ ও জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হলো এবারের স্বাধীনতা।এ বিজয় ছাত্র-জনতার বিজয়, এ বিজয় তারুণ্যের বিজয় অপশাসনের বিরুদ্ধে সুশাসনের বিজয়।এ বিজয় দীর্ঘদিন জাতির বুকে পাথরের ন্যায় চেপে বসে থাকা নির্যাতন-নিপীড়নকারী শাসকের বিরুদ্ধে নির্যাতিত-নিপীড়িত মানবতার বিজয়।এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে ছাত্র-জনতা।তরুণরাই পারে সকল বাধা বিপত্তিকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে বিজয় মাল্য ছিনিয়ে আনতে।পারে বিপ্লবকে সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে পৌঁছাতে।সার্বিকভাকে এটি ছিল বাংলার ইতিহাসে সামাজিক আন্দালনের সফল পরিনতির বিজয়।

তরুণরাই পারবে এঘুনে ধরা সমাজটাকে মেরামত করতে,যেভাবে রাষ্ট্র মেরামত করছে তারা। সমাজের ঝুঁকিপূর্ণ, অবহেলিত, প্রান্তিক ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা, জীবনমান উন্নয়নের বিষয়টি সদাজাগ্রত রাখাই হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা । বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের খাদ্য পায়, আশ্রয় পায়,বাক স্বাধীনতা পায়,জীবনের নিরাপত্তা পায় এবং সুন্দর জীবনের অধিকারী হয় এগুলোই হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তারই কম্পোনেন্ট । সংবিধানের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুসারে নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।অর্থাৎ বেকারত্ব,ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য,মাতা-পিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার।
সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে বয়স্কভাতা,বিধবা, স্বামী নিগৃহীতা মহিলাভাতা, মুক্তিযোদ্ধা সম্মানীসহ নানা ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করা হয়। পরবর্তী সময়ে প্রতিবন্ধি সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র, প্রতিবন্ধি শিক্ষা, উপবৃত্তি, হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন, ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, জন্মগত হৃদরোগ, স্ট্রোক ও থ্যালাসেমিয়া রোগীদের আর্থিক সহায়তা, প্রতিবন্ধি মোবাইল থেরাপি ভ্যান চালুসহ নানাবিধ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্র্তৃক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার সঙ্গে সঙ্গে আরও ২৫টির বেশি মন্ত্রণালয় সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় সমাজসেবা অধিদফতর কর্তৃক পরিচালিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বয়স্কভাতা, বর্তমানে উপকারভোগীর সংখ্যা ৪৯ লাখ, আর্থিক বরাদ্দ ২৯৪০ কোটি টাকা; বিধবা, স্বামী নিগৃহীতা মহিলাভাতা, উপকারভোগীর সংখ্যা ২০ লাখ ৫০ হাজার, আর্থিক বরাদ্দ ১২২০ কোটি টাকা; অসচ্ছল প্রতিবন্ধীভাতা, বর্তমানে উপকারভোগীর সংখ্যা ১৮ লাখ, আর্থিক বরাদ্দ ১৬২০ কোটি টাকা; প্রতিবন্ধি শিক্ষা উপবৃত্তি, উপকারভোগীর সংখ্যা ১ লাখ, আর্থিক বরাদ্দ ৯৫.৬৪ কোটি টাকা; হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি, উপকারভোগীর সংখ্যা ৬ হাজার, আর্থিক বরাদ্দ ৬ কোটি টাকা; বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি, উপকারভোগীর সংখ্যা ৮১ হাজার ৪২০ জন, আর্থিক বরাদ্দ ৭৫.৯৮ কোটি টাকা; চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি, উপকারভোগীর সংখ্যা ৫০ হাজার; ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, জন্মগত হৃদরোগ, স্ট্রোক ও থ্যালাসেমিয়া রোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি, উপকারভোগীর সংখ্যা ৩০ হাজার, আর্থিক বরাদ্দ ১৫০ কোটি টাকা; বেসরকারি এতিমখানা ক্যাপিটেশন গ্রান্ট, উপকারভোগী প্রায় ১ লাখ, বরাদ্দ ২৩১ কোটি টাকা; পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রমের আওতায় আয়বর্ধক কর্মসূচি, বর্তমান মূলধনের পরিমাণ প্রায় ৫২১ কোটি টাকা, উপকারভোগীর সংখ্যা ২৬ লাখের বেশি।এছাড়াশিশু-কিশোর, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি, শারীরিক প্রতিবন্ধি, মানসিক প্রতিবন্ধি এবং বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধিদের কল্যাণ ও উন্নয়নেবিভিন্নকার্যক্রমপরিচালনাকরাহচ্ছে।
এছাড়া শিশু-কিশোর, দৃষ্টি প্রতিবন্ধি, শারীরিক প্রতিবন্ধি, মানসিক প্রতিবন্ধি এবং বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধিদের কল্যাণ ও উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সম্মানীভাতা, উৎসবভাতা, বাংলা নববর্ষ এবং মহান বিজয় দিবসভাতা, উপকারভোগীর সংখ্যা ২ লাখ, বরাদ্দ ৩৪৭৩ কোটি টাকা।মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় দরিদ্র মা’র জন্য মাতৃত্বকালীনভাতা, উপকারভোগীর সংখ্যা ৭ লাখ ৭০ হাজার, বরাদ্দ ৭৩৯.২০ কোটি টাকা; কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিল, উপকারভোগীর সংখ্যা ২ লাখ ৭৫ হাজার, বরাদ্দ ২৬৪ কোটি টাকা; ভিজিডি কার্যক্রম, উপকারভোগীর সংখ্যা ১০ লাখ ৪০ হাজার, বরাদ্দ ১৬৮৫ কোটি ৭ লাখ টাকা।দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান, উপকারভোগীর সংখ্যা ৯ লাখ ৬৭ হাজার, বরাদ্দ ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা (২০১৮-১৯); খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি (৫ মাসের জন্য), উপকারভোগীর সংখ্যা ৫০ লাখ পরিবার, বরাদ্দ ৬৩৬ কোটি টাকা।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর ধারাবাহিকতা পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, উপকারভোগীর সংখ্যা এবং আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ শুরু থেকে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বয়স্ক ভাতার উপকারভোগী এবং আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ১২.১৫ ও ৬০ গুণ। বিধবা, স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতার উপকারভোগী এবং আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ৫.০৮ ও ৩০.৫ গুণ।
অসচ্ছল প্রতিবন্ধি ভাতার উপকারভোগী এবং আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ১৭.৩১ ও ৬৪.৮ গুণ। প্রতিবন্ধি শিক্ষা উপবৃত্তির উপকারভোগী এবং আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ৭.৬৭ ও ১৬ গুণ। বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচির উপকারভোগী এবং আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ৫.৪ ও ৮ গুণ। চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচির উপকারভোগী এবং আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ৫ ও ৫ গুণ। ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, জন্মগত হৃদরোগ, স্ট্রোকে প্যারালাইসিস ও থ্যালাসেমিয়া রোগীর উপকারভোগী এবং আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ১৫ ও ১৫ গুণ। বেসরকারি এতিমখানা ক্যাপিটেশন গ্রান্ট এ উপকারভোগী এবং আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ৪ ও ১০ গুণ।মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেয়া হচ্ছে ২ লাখ। বর্তমানে লাইফ সাইকেল অ্যাপ্রোচের আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ৯২ লাখ অ্যাপ্রোচের আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যার (৯২ লাখের) চেয়ে কম। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের ঝুঁকিপূর্ণ, অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষাকে আইনি বলয়ের আওতায় আনার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল, ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন ২০১১, শিশু আইন ২০১৩, প্রতিবন্ধি ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩, পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩, নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধি সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩ এবং বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ আইন ২০১৯।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মানবসম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র্যমোচন, কল্যাণ, উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন সাথে সংশ্লিষ্ট একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়।সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, প্রতিবন্ধিভাতা, এসিডদগ্ধ ও প্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের সহায়তা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।একই সাথে দেশব্যাপী গ্রামীণ এবং শহুরে উভয় এলাকায় সমাজের পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর অংশ,বেকার, ভূমিহীন, অনাথ, দুঃস্থ, ভবঘুরে, নিরাশ্রয়, সামাজিক, বুদ্ধিমত্তা এবং শারীরিক প্রতিবন্ধি ব্যক্তি, দরিদ্র, অসহায়রোগী, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের কল্যাণ ও উন্নয়নে বহুমাত্রিক এবং নিবিড়কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

লেখক: (সিনিয়রতথ্যঅফিসার) জনসংযোগ কর্মকর্তা
-পি. ফি.

0 Shares