অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর আমাদের মাঝে পহেলা বৈশাখ আসছে এক নতুন মাত্রা নিয়ে। বাংলা ১৪৩১ সন ছিল আমাদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক পর্যায়ে রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। যার ফলে তৎকালীন ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটে এবং জাতির সামনে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের সুযোগ আসে। পয়লা বৈশাখ বাংলাদেশের চিরন্তন উৎসব, বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। পয়লা বৈশাখ আমাদের আপন শিকড়ের প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হওয়ার দিন, বাঙালির প্রাণের উৎসবের দিন। বাঙালি আবহমান লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যে বর্ষবরণ উৎসবে মেতে ওঠে সারাদেশ। বাংলা নববর্ষ পালন এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। ধর্ম, বর্ণ সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি জাতি এই নববর্ষকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়।
বাংলা নববর্ষ নতুন ব ছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিলনা। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ ঋতু ধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। সৌরপঞ্জি অনুসারে বাংলা মাস পালিত হতো অনেক প্রাচীন কাল থেকেই। তখনও আসাম, তামিলনাড়ু, ত্রিপুরা, বঙ্গ, পাঞ্জাব প্রভৃতি সংস্কৃতিতে বছরের প্রথম দিন উদ্যাপনের রীতি ছিল। বাংলা সনের প্রবর্তক নিয়ে সম্রাট আকবর বেশি আলোচিত হলেও, বাংলা পঞ্জির উদ্ভাবক ধরা হয় আসলে ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্ককে। পরবর্তীতে সম্রাট আকবর সেটিকে পরিবর্তিত করেন খাজনা ও রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে। প্রথমে আকবরের পঞ্জিকার নাম ছিল ‘তারিখ-এ-এলাহী’। আর ঐ পঞ্জিকায় মাস গুলো আর্বাদিন, কার্দিন, বিসুয়া, তীর এমন নামে ছিল । তবে ঠিক কখন যে এই নাম পরিবর্তন হয়ে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ হলো তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেনা। ধারণা করা হয় বাংলা বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন নক্ষত্র থেকে। যেমন – বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জ্যৈষ্ঠ, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ এমন করেই বাংলায় নক্ষত্রের নামে মাসের নামকরণ হয়েছে।
ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য পরিচালিত হতো, হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে। আর হিজরি পঞ্জিকা চাঁদের উপর নির্ভরশীল ছিল । যেহেতু কৃষকদের কৃষিকাজ চাঁদের হিসাবের সাথে মিলতো না, তাই তাদের অসময়ে খাজনা দেয়ার অসুবিধা দূর করার জন্য সম্রাট আকবর বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনেন। তখনকার বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহসিরাজি সম্রাট আকবরের আদেশে সৌরসন ও হিজরিসন এর উপর ভিত্তি করে বাংলা সনের নিয়ম তৈরি করেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চবা ১১ মার্চথেকেপ্রথমবাংলাসনগণনাকরাহয়। তবেআনুষ্ঠানিকভাবেইখাজনাআদায়েএইগণনাকার্যকরশুরুহয়েছিলো ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বরথেকে। পূর্বেফসলকাঁটা ও খাজনাআদায়েরজন্য ঐ বছরেরনামদেয়াহয়েছিলফসলিসন। পরেতাবঙ্গাব্দআরবাংলাসনকরাহয়। তখনচৈত্রমাসেরশেষদিনেরমধ্যেখাজনা, শুল্কদিতেহতোকৃষকদের। তাইতখনথেকেইসম্রাটআকবরকৃষকদেরজন্যমিষ্টি ও সাংস্কৃতিকঅনুষ্ঠানেরআয়োজনকরতেন। হালখাতারপ্রচলনওসম্রাটআকবরেরসময়থেকেইব্যবসায়ীরাশুরুকরেছিলো।
পহেলাবৈশাখ, বাংলাসনেরপ্রথমদিন। এ দিনটিবাংলাদেশ ও ভারতেরপশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরাসহদেশবিদেশেবসবাসরতপ্রত্যেকটিবাঙালিনববর্ষহিসেবেপালনকরে। সেহিসেবেএটিবাঙালিদেরএকটিসর্বজনীনপ্রাণেরউৎসব। বর্তমানেরবাংলাসনএসেছেগ্রেগরীয়বর্ষপঞ্জিঅনুসারে। বাংলাদেশেএইগ্রেগরীয়বর্ষপঞ্জিঅনুসারেপ্রতিবছর ১৪ এপ্রিলশুভনববর্ষপালনকরাহলেওপশ্চিমবঙ্গেতা ১৫ এপ্রিলপালনকরাহয়। কারণ, ভারতেহিন্দুসম্প্রদায়তিথিপঞ্জিকাঅনুসরণকরেথাকে। বাংলাদেশেআধুনিকবাংলাবর্ষপঞ্জিকায়গ্রেগরীয়পঞ্জিকাঅনুসারেবাংলাএকাডেমি ১৪ এপ্রিলকেবাংলাবছরেরপ্রথমদিননির্দিষ্টকরেদিয়েছে।
বাঙালিরনববর্ষউদ্যাপনেরঅন্যতমআকর্ষণহলো‘মঙ্গলশোভাযাত্রা’। ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়েরচারুকলাঅনুষদ ১৯৮৯ সালথেকেনিয়মিত এ শোভাযাত্রাবেরকরে।শুরুতেনামছিল ‘আনন্দশোভাযাত্রা’।নব্বইয়েস্বৈরাচারবিরোধীআন্দোলনেরপটভূমিতেঅমঙ্গলকেদূরকরেমঙ্গলেরআহ্বানজানিয়েশোভাযাত্রারনামকরণহয় ‘মঙ্গলশোভাযাত্রা’।২০১৬ সালেইউনেস্কো, এটিকে‘মানবতারঅমূল্যসাংস্কৃতিকঐতিহ্য’হিসেবেঘোষণাকরে। মঙ্গলশোভাযাত্রাএখনবাংলাদেশেরনবতরসর্বজনীনসাংস্কৃতিকএবংপ্রধানধর্মনিরপেক্ষউৎসবহিসেবেবাঙালিরজীবনেনতুনমাত্রাযোগকরেছে। এইআয়োজনেদেশিবিদেশিজাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষেসকলশ্রেণিপেশারমানুষস্বতঃস্ফূর্তভাবেঅংশগ্রহণকরেথাকে।এবছরথেকে‘মঙ্গলশোভাযাত্রার’নামপরিবর্তনকরে‘বর্ষবরণআনন্দশোভাযাত্রা’করাহয়েছে। এ বছরনববর্ষেরশোভাযাত্রায়বাঙালিছাড়াও ২৭ জাতিগোষ্ঠীঅংশগ্রহণকরবে। শোভাযাত্রায়কৃষকএকটিবড়থিমহিসেবেথাকবে। এ ছাড়াফিলিস্তিনেরপতাকাহাতেশান্তিরবার্তাওথাকবেএবং ২ শতগিটারিস্টনিয়েফিলিস্তিনেইসরায়েলেরগণহত্যারপ্রতিবাদেগানপরিবেশনকরবেরকস্টারব্যান্ডবামবা। ঐদিনবিকেলেমানিকমিয়াঅ্যাভিনিউয়েকনসার্টঅনুষ্ঠিতহবে। এ ছাড়াচীনাদূতাবাসেরঅর্থায়নেবিকেলেড্রোনশোহবে। যেখানে ২৪-এর জুলাইছাত্র-জনতারআন্দোলনসহবিভিন্নবিষয়েরওপরআয়োজনথাকবে। সোহরাওয়ার্দীউদ্যানেকনসার্টহবেচৈত্রসংক্রান্তিরসন্ধ্যায়। প্রতিবারেরমতোএবারওছায়ানটেরঅনুষ্ঠানহবে। তবেস্থানবদলেসুরেরধারারঅনুষ্ঠানটিএবাররবীন্দ্রসরোবরেহবে। সরকারেরঅন্তর্ভুক্তিমূলকনীতিরসঙ্গেএকাত্মতাপ্রকাশকরেসুরেরধারাএবারবাংলাগানেরবাইরেওভিন্নআয়োজনরাখবে । সন্ধ্যায়জাতীয়নাট্যশালামিলনায়তনেআয়োজনকরাহবেবৈশাখিসাংস্কৃতিকঅনুষ্ঠান। আসন্নবাংলানববর্ষএবংপাহাড় ও সমতলেরজাতিগোষ্ঠীদেরবর্ষবরণউৎসবউপলক্ষ্যেপার্বত্যচট্টগ্রামএলাকায়সাজসাজরবপড়েছে। সবশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেবাংলানববর্ষউদ্যাপনেরসিদ্ধান্তদেওয়াহয়েছে। নববর্ষউপলক্ষ্যেসবমাদ্রাসায়নিজস্বব্যবস্থাপনাউৎসবমুখরপরিবেশে ও সাড়ম্বরেদুদিনব্যাপীঅনুষ্ঠানআয়োজনকরারকথাজানিয়েনির্দেশনাজারিকরেছেশিক্ষাঅধিদপ্তর। বাংলানববর্ষেরঅন্যতমঅনুষঙ্গবৈশাখিমেলা। তাইবৈশাখমাসকেবলাহয়মেলারমাস। বাংলানববর্ষউপলক্ষ্যেজেলায়জেলায়বৈশাখিমেলারেওআয়োজনকরাহয়েছে।
আগামীসোমবারসূর্যোদয়েরসঙ্গেসঙ্গেবাংলাবর্ষপঞ্জিতেযুক্তহবেনতুনবর্ষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ। বিদায়ী ১৪৩১ এরসবভুল-ত্রুটি, ব্যর্থতা, গ্লানিআরনাপাওয়াকেভুলেনতুনউদ্যমে ১৪৩২ কেস্বাগতজানাতেপ্রস্তুতধর্ম-বর্ণনির্বিশেষেপুরোজাতি। এ উপলক্ষ্যেমাননীয়প্রধানউপদেষ্টাদেশবাসীকেশুভেচ্ছাজানিয়েবাণীদিয়েছেন। নতুনবছরেতারুণ্যেরদৃষ্টিকোণথেকেগড়েতুলতেহবেবৈষম্যহীনবাংলাদেশকে। তরুণরাইথাকবেস্বপ্নেরবাংলাদেশগড়ারনেতৃত্বে । সেবা ও মানবিকতারবাণীপৌঁছেদিতেহবেসবারকাছে। আমাদেরপ্রধানউপদেষ্টাঅধ্যাপকমুহাম্মদইউনূসবিদেশিবিনিয়োগকারীদেরবলেছেন,‘বাংলাদেশএমনএকটিদেশ, যারবিশ্বকেবদলেদেওয়ারঅভিনবসবধারণারয়েছে। এসবধারণাকেবাস্তবেরূপদিতেহবে। আরএরমাধ্যমেশুধুবাংলাদেশকেনয়, পুরোবিশ্বকেইবদলেদেওয়াসম্ভব’। আর এ বিশ্বাসকেধারণকরেএগিয়েনিতেহবেবাংলাদেশকে। নতুনবর্ষআমাদেরসকলেরজীবনেমঙ্গলবয়েআনুক এ প্রত্যাশা ।
-পি. ফি.