Home » ইতিহাস ঐতিহ্য » স্মৃতির ক্যানভাসে নূতন খয়েরতলা স্কুল
স্মৃতির ক্যানভাসে নূতন খয়েরতলা স্কুল

স্মৃতির ক্যানভাসে নূতন খয়েরতলা স্কুল

বি এম ইউসুফ আলী :

১৯৭৩ সালে আমাদের গ্রামে একটি প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন তার নাম ছিল স্বনির্ভর নূরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। বর্তমানে এটির নাম মুন্সি বেলায়েত আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানেই আমি প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় আমি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হই। সিরাজ প্রথম, আর তৃতীয় হয়েছিল সিরাজের ভাগ্নি নাসিমা।

১৯৮১ সালে আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই নূতন খয়েরতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে । এই স্কুলটি ১৯৬৩ সালে যশোর শহরের উপকন্ঠে পালবাড়ী মোড় এলাকায় স্থাপিত হয়। এলাকার বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে ২.১৫ একর জমির উপর এক প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে গড়ে উঠেছে স্কুলটি।

সম্ভবত ১৯২২ সালের দিকে একটি জুনিয়র মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সেনানিবাস সম্প্রসারণ জনিত কারণে মাদ্রাসাটি বর্তমান খয়েরতলা নামক স্থানে স্থানান্তরিত করা হয়। এই মাদ্রাসাটির ক্ষতিপূরণ স্বরূপ সরকার ৩০ হাজার টাকা প্রদান করে। সেই অর্থ দিয়ে নূতন খয়েরতলায় একটি ফোরকানিয়া মাদ্রাসা পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সূত্র ধরেই মাদ্রাসাটি চালু রেখে ১৯৬৩ সালে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে স্বল্প সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে এই স্কুলের যাত্রা শুরু হয় এবং ১৯৬৩ সালেই মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে যশোর শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন লাভ করে।

আরও পড়ুনঃ কমলগঞ্জে ভোজ্য তেলের দাম বাড়ায় বিপাকে নিম্ন আয়ের মানুষ

জাতিসংঘের টেকসই শান্তি প্রচেষ্টার প্রতি সুদৃঢ় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করল বাংলাদেশ

যে সকল বিদ্যানুরাগীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম শরফুদ্দিন আহম্মদ, মুহাম্মদ ইসমাইল চাকলাদার, একেএম আব্দুল মজিদ, মো: ফজলুর রহমান এবং পরবর্তীতে যাঁদের অগ্রণী ভূমিকায় বিদ্যালয়টিকে আজকের এই পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে বিশেষ স্মরণীয় আহম্মদ আলী সরদার, আব্দুর রহমান ও তৎকালীন প্রথম প্রধান শিক্ষক এসএ আজিজুল হক। বিদ্যালয়টি এখন যশোর জেলার একটি গৌরবময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

আমার সহপাঠী সিরাজ, মফিজ, আশরাফ, সোহরাব, হারুন, লুৎফর, রাশিদা,নাসিমা, আইয়ুব এবং হেনাও ভর্তি হয়েছিল নূতন খয়েরতলা স্কুলে । আইয়ুব ও নাসিমার পাঠ শেষ হয় ষষ্ঠ শ্রেণিতেই। নাসিমার বিয়ে হয়ে যায়। আর আইয়ুব কর্মে লেগে পড়ে। তৎকালীন সময়ে আমাদের গ্রামের ৮০% শিক্ষার্থীরা সেখানে লেখাপড়া করত। বাদবাকিরা বিশেষ করে দক্ষিণপাড়ার ছেলেমেয়েরা ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে আর উত্তরপাড়ার শিক্ষার্থীরা চুড়ামনকাটি স্কুলে লেখাপড়া করত।

এই স্কুলে আমি তিন বছর পড়েছি। নবম শ্রেণিতে উঠে অন্য একটি স্কুলে ভর্তি হই। এরপর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি। ইতোমধ্যে কেটে গেছে ৩৭ বছর। কিন্তু নূতন খয়েরতলা স্কুলের সেই তিন বছরের স্মৃতি এখনো ভুলতে পারি নি। এখনো মন পড়ে আছে সেই স্কুলের আঙিনায়। ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে আসা ধূসর স্মৃতিগুলো বারবার কড়া নাড়ে মনের দুয়ারে। ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই সোনালি দিনগুলোতে। ফিঁকে হয়ে আসা স্মৃতিগুলো উদ্ভাসিত হয় স্বর্ণদীপ্তিতে। কেন এই আকুলতা! কেন এই বারবার ফিরে চাওয়া! কেন ভুলতে পারিনা সেসব দিনের কথা!

আমদের গ্রাম থেকে স্কুলের দূরত্ব তিন কিলোমিটার। আমরা দলবেঁধে হেটে স্কুলে আসা-যাওয়া করতাম। মুষ্টিমেয় কয়েকজন সাইকেলে যেত। ছুটির পর অনেক সময় বাসে এসে ক্যান্টনমেন্ট খয়েরতলা বাজারে নেমে যেতাম । সামান্য পথ, সেই সাথে ছাত্র তাই হেল্পাররা আমাদেরকে বাসে উঠতে দিতে চাইত না। আমরা অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাসের বাম্পারে উঠে পড়তাম। বৃষ্টির দিনে স্কুলে যাতায়াতে ভীষণ কষ্ট হত। কাঁদাপথ মাড়িয়েই যেতে হত। তারপরও নিয়মিত স্কুলে যেতাম। কামাই দিতাম না।

স্কুলের সেই সবুজ ঘাসের মাঠ আজো বুকে জাগায় শিহরণ। স্কুল শুরুর ঠিক আগে আগে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা — সেই প্রিয়মুখ একঝলক দেখবো বলে। প্রিয় বন্ধুর সাথে বসবো বলে বই দিয়ে জায়গা দখল, ক্লাসের ফাঁকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করা, স্যারের বেতের বাড়ি এড়াতে ছোট করে চুল কাটা, টিফিন পিরিয়ডে সারা মাঠ ছুটোছুটি করে হাপিয়ে গিয়ে টিউবওয়েলের চাপ দিয়ে দু’হাত একত্রে করে পড়ন্ত পানি পান করে পিপাসা মেটানো আরো কত কি!! কতটা বছর কেটে গেছে, জীবনের কত স্মৃতি হারিয়ে গেছে! তবু স্কুল জীবনের স্মৃতিরা পাখা মেলে ব্যস্ত সময়ের খানিক অবসরে।

স্কুল জীবনের সেই দিনগুলোর কথা আজকাল খুবই মনে পড়ে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমাদের ক্লাস টিচার ছিলেন আলী আকবর স্যার । তিনি ইসলামিয়াত ও আরবি পড়াতেন । তিনি সারাক্ষণ পান খেতেন। ঠোঁট লাল থাকত বিধায় আমরা ওনার নাম দিয়েছিলাম লিপিস্ট স্যার। রাজ্জাক স্যার বাংলা ক্লাস নিতেন। তিনি ক্লাসে ডিটেকশন লিখাতেন। আমার নামের প্রথমে বি এম থাকায় তিনি বলতেন দায়ের চেয়ে আছাড় বড়। একথা শুনে খুব খারাপ লাগত। তার একটি কমন ডায়লগ ছিল “মোটে রান্দে না মা, তত্তর পান্তা।” একবার পুলিশ লাইনের কাছে সাইকেল ভেঙে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন গেম টিচার। লম্বা, ফর্সা আর চোখ ছিল বড় বড়। তিনি পরবর্তীতে কাজী নজরুল কলেজ চলে গিয়েছিলেন। বিজ্ঞানের স্যার ছিলেন শাহবুদ্দিন স্যার। আর ইউসুফ স্যার ইংরেজি ক্লাস নিতেন। পড়া না পারলে তিনি এমন কথা বলতেন যা শুনলে পিত্তি জ্বলে যেত। আমরা তাকে ভীষণ ভয় পেতাম। মাহবুব স্যার ছিলেন স্মার্ট। ঝাকড়া চুল আর ফনিক্স সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসতেন। সমাজ ক্লাস নিতেন শামসুর রহমান স্যার। আমাদের হেড স্যারের নাম ছিল শহীদুল্লাহ্। তিনি রাস ভারি মানুষ ছিলেন। আমাদেরকে খুবই কড়া শাসনে রাখতেন। অন্যায় করলে নির্ঘাত বেতের বাড়ি পড়ত পিঠে। নয়তো কিল-ঘুষি। সহকারি প্রধান শিক্ষক ছিলেন সিদ্দিক স্যার। তিনি ছিলেন হেড স্যারের সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মি। যাকে বলে মাটির মানুষ। সায়েন্সের ওহিদুর রহমান স্যারকে আমি কখনো হাসতে দেখেনি। তিনি বিজ্ঞান ও গণিত ক্লাস নিতেন। সোলায়মান স্যার সুন্দর করে কথা বলতেন। শুদ্ধভাবে বাংলা উচ্চারণ করতেন। আমরা ক্লাস সেভেন বা এইটে থাকতে তিনি আমাদের স্কুলে চাকরি পান। স্যারের দাঁতগুলো ছিল মুক্তার মতো দেখতে। কোনো একদিন এক নতুন স্যার সমাজ ক্লাস নিতে আসেন। নাম ভুলে গিয়েছি। তাকে আমরা অগচরে কাম্পিয়ান স্যার বলে ডাকতাম। কারণ তিনি পড়াতে গিয়ে কাস্পিয়ান সাগরের নাম উচ্চারণ করেছিলেন কাম্পিয়ান সাগর । তিনি অফিস সহকারি পদে তখন সবেমাত্র জয়েন করেছেন। কৃষিবিজ্ঞানের আবুল স্যার ছিলেন আমাদের বান্ধবী আন্নার দুলাভাই। আন্নার আড়ালে এটি নিয়ে আমরা একটু রসিকতা করতাম। শহীদ স্যার ও আনোয়ার স্যারের চেহারা ভুলে গেছি।

আমরা আট ভাইবোন ছিলাম। বড়ভাই মরহুম আবুল কাশেম ছাড়া আমরা সকলেই নূতন খয়েরতলা স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলাম। যার ফলে আগে থেকেই স্যারদের নামধাম জানা ছিল। এমন কি তারা কে কেমন ছিলেন সে সম্পর্কেও কিছুটা ধারণা ছিল।

আমাদের এই স্কুলটি এল আকৃতির একটি দ্বিতল ভবন। দক্ষিণ থেকে উত্তর, তারপর পশ্চিমে দিকে প্রসারিত ভবনটি। নীচ তলায় পশ্চিম দিকের কয়েকটি কক্ষে প্রাইমারি স্কুলের ক্লাস হত। আর আমাদের ষষ্ঠ শ্রেণির ক্লাস হত প্রাইমারি স্কুলের সংলগ্ন একটি প্রশস্ত রুমে। ক্লাস শেষ হলে আমরা বারান্দায় টুকটাক আড্ডা দিতাম। ক্লাস সিক্সের কথা। একদিন আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু বারান্দায় আড্ডা দিচ্ছিলাম। প্রাইমারি স্কুলের আলম স্যার আমাদের ক্লাসের সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। পিছন থেকে বন্ধু হারুন ওনার কাঁধে হাত রেখে সামনে হেটে চলেছে। তিন-চার কদম যেতেই হারুন বুঝতে পারল তার ভুল। আর অমনি মুখ লুকিয়ে দৌঁড়। তিনিও হয়তো টের পেয়েছিলেন পোলাপান ভুল করেছে। সে যাত্রায় হারুন মারের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যায়।

এভাবে ষষ্ঠ শ্রেণির প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা শেষ করেছি। এ দুটি পরীক্ষায় কী রেজাল্ট করেছিলাম মনে নেই। এ পরীক্ষাগুলোর রেজাল্ট বার্ষিক পরীক্ষায় কোনো প্রভাব ফেলত না। আসল হচ্ছে বার্ষিক পরীক্ষা। যথাসময়ে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হল। রেজাল্টের দিন আব্বা স্কুলে গেলেন আমার বকেয়া বেতন পরিশোধ করতে। আমি আমার পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে খুব টেনশনে আছি। কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না হলে মহা মুসিবত । প্রায় সকল শিক্ষক আব্বাকে চেনেন। অপেক্ষার পালা শুরু হল। কখন দিবে রেজাল্ট। অবশেষে তার অবসান হল ।

শীতের সকাল। মিষ্টি রোদ। রেজাল্ট কার্ড নিয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে আছি। দেখলাম দুই যমদূত আব্বা আর ইউসুফ স্যার আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। এক নিমিষেই শরীরের টেম্পারেচার বেড়ে গেল। কান গরম হয়ে গেছে কিনা পরীক্ষা করলাম। ওনারা কাছে আসতেই আমি সালাম দিলাম। ইউসুফ স্যার মাথা নেড়ে উত্তর নিলেন। আব্বা স্যারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ঐ মুহূর্তে আব্বা কী কী বলেছিলেন তা আমার কানে মোটেও ঢুকেনি। কারণ, আশানুরূপ রেজাল্ট না হওয়ায় আমি তখন ভয়ে ভয়ে ছিলাম । মাত্র দু-তিনটা শব্দ কানে পৌঁছেছিল । আর তাহল ‘ওনি তোমার চাচা হন। বাড়ি গুবলে গ্রামে।’ আব্বার নির্দেশ মত রেজাল্ট কার্ডটি ইউসুফ স্যারকে দিলাম। স্যার খুটিয়ে খুটিয়ে তা দেখলেন এবং আমাকে এপ্রিশিয়েট করলেন। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে হল আমি বাঘের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া এক ক্ষুদ্র প্রাণী। পরীক্ষায় প্রায় সাড়ে ছয়শ নম্বর পেয়েছিলাম। সপ্তম শ্রেণিতে আমার রোল নম্বর হয়েছিল ১২ কিংবা ১৪। বন্ধু জামাল প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। সে নওদাগ্রামে তার নানা বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত। দেখতে খুবই সুন্দর ছিল। গায়ের রং যেন দুধে আলতা। ওবায়দুল, আহসান কবির বাবু, সিরাজ, স্বপন, পারভেজ (লিটন), রাশিদাসহ আরো কয়েকজন ভালো রেজাল্ট করেছিল।

যে “ভুলে ভুলুক কোটি মন্বন্তরে, আমি ভুলিবো না, আমি কভু ভুলিবো না” – জীবনের যত মধুর ভুলগুলো আজ বার বার হাত ছানি দিয়ে ডাকে। ফিরিয়ে নিয়ে যায় কৈশোরের সেই সোনালি দিনগুলোতে। যেখানে স্মৃতিরা ডানা মেলে মুক্ত বিহঙ্গের মত। স্কুলের রুটিন বাধা জীবনের এক ঘেয়েমীর মাঝে ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখা, খেলার মাঠের এককোণে গিয়ে আড্ডা মারা, ক্লাস শেষে স্কুল মাঠে ফুটবল খেলা, লুকিয়ে সিগারেটে সুখটান দেয়া – এসবই ছিলো আমাদের বিনোদন। তবে বার্ষিক ক্রীড়া ও পুরস্কার বিতরণীর দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। বন্ধু সাইফুল ইসলাম স্বপন একটি নাটকে খরগোশের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল বলে ওকে খরগোশ স্বপন নামেই সকলে চিনত।

স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে এটা-ওটা কেনা, আইক্রিম খাওয়া। টিফিন বক্সে করে টিফিন নিয়ে আসার সংস্কৃতি ছিল না। স্কুল থেকেই টিফিন দেওয়া হত। প্রথম প্রিয়িয়ডে স্কুলের দপ্তরি মোতালেব ভাই উপস্থিতি নিয়ে যেতেন। টিফিনে কী খাবার দেওয়া হবে সেজন্যে। সিঙ্গারা, সমুচা,বনরুটি ও কলা, পেটিস, কেক, ক্রীমরোল ইত্যাদি আইটেমের টিফিন দেওয়া হত। মাঝেমধ্যে স্কুলের আরেক দপ্তরি আবু তালেব দাদাও এ কাজটি করতেন। তিনি কানে কম শুনতেন। কিন্তু কান নাড়িয়ে আমাদের আনন্দ দিতেন। বলা যায় তখন আনন্দের কমতি ছিলো না।

আমাদের স্কুলে কো- এডুকেশন ছিল। কিন্তু মেয়েরা কমনরুম থেকে স্যারদের সাথে ক্লাসে আসা যাওয়া করত। কদাচিৎ তাদের সাথে কথা হত। তাও রাস্তাঘাটে। শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষজন কনজার্ভেটিভ ছিল। ছেলে মেয়েদের কথা বলতে দেখলেই ভাবত কি না জানি কি। আমাদের অনেক বন্ধুকে দেখেছি একজন মেয়েকে প্রেম নিবেদন করার জন্য তার পিছনে কয়েকজনকে ঘুরতে। কিন্তু সেই মেয়ে কাউকে পাত্তা দিত না। কাউকে ভালো লাগলে বলার উপায় ছিল না। অথচ আজকের ডিজিটাল যুগে প্রেমের কায়দা কানুন পাল্টে গেছে। যেন “ফেসবুকে ফটো দেখে প্রেমে পড়েছি” – এই টাইপের। তারপরও বলতেই হয় -“আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম”।

​কলেজ কিংবা ভার্সিটি লাইফের বন্ধুত্ব নাকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায়। কিন্তু স্কুল লাইফের বন্ধুত্ব কখনো ভোলা যায়না। একটা সময়ে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও সেই পুরানো বন্ধুত্বটা ঠিকই মজবুত থাকে। এই কথার সঙ্গে একমত হবেন অনেকেই। কারণ পরবর্তী জীবনের বন্ধুরা স্কুল জীবনের বন্ধুদের মতো নিখাঁদ হয় না। স্কুল জীবনের বন্ধুরা সমপর্যায়ের না হলেও এদের কথা ভোলা যায় না। তাইতো আজও তাদের ভুলতে পারিনি।

আমাদের গ্রামের সকল বন্ধুর সাথে আমার যোগাযোগ আছে। হেনার সাথে যোগাযোগ নেই অনেক দিন। ও আমার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে। ক্লাস এইটে থাকতেই লুৎফর চট্রগ্রামে চলে যায়। সেই অবদি ওর সাথে আর দেখা হয় নি। লেখাপড়ায় দারুণ সিরিয়াস ছিল মশিয়ার। আমার ইমিডিয়েট বড়ভাইয়ের সাথে একত্রে চাকরি করে। বেশ কয়েক বছর আগে আমার বাবা ও বড় ভাইয়ের খানাতে ওর সাথে দেখা হয়েছিল।

আমাদের সাথে কয়েক জোড়া সহোদর ছিল। শাহীন-লিটন,মনি-রবি এবং মান্নান-টিপু। শাহীন ও লিটন আমাদের হেডস্যার শহীদুল্লাহ্ স্যারের দুই ছেলে। ফিরোজ পারভেজ লিটন বেশ স্মার্ট ছিল। ওর চাচাতো ভাই সাইফুল ইসলাম স্বপন। নিরিবিলি নিশ্চুপ টাইপের সুবোধ বালক ছিল ওবায়দুল। যথেষ্ট মেধাবী ছিল। বাবু নামে দুইজন ছিল। আহসান কবির বাবু আর খবির উদ্দিন বাবু। আহসান কবির বাবু বর্তমানে যশোর প্রেসক্লাবের সেক্রেটারি। খবির পালবাড়িতে একটা ব্যবসা করে। খাইরুল ইসলাম দারার বাসা ছিল হেড স্যারের বাসার পাশেই। কবুতর পোষা ওর নেশা ছিল। এই দিক দিয়ে আমার সাথে ওর একটি মিল ছিল। বন্ধু আলমগীর হোসেন মিন্টু একজন ব্যবসায়ী। ক্যান্টনমেন্ট কলেজে একত্রে পড়েছি। মিন্টু দারুণ মিশুক। সকলের সাথে ওর যোগাযোগ আছে। ডাকাতিয়া গ্রামের ৩/৪ জন বন্ধু আমাদের সাথে পড়ত। হাবিবুর রহমান , সিরাজুল ইসলাম মিলন আর রবিউল। রবিউল ঢাকার শেওড়াপাড়ায় থাকে। আমার সাথে তার প্রায়ই দেখা হয়। হাবিবুর আমাদের খয়েরতলা স্কুলের শিক্ষক। আমিনুর, সেলিম, সাগর, এনায়েত, নূরে আলম, ফয়েজ, সাঈদ, বাবলু, মহিউদ্দিন, মোজাফফর, আন্না, রাশিদা,সুরাইয়া, হাসিনা, লতিফা, রাবেয়া, মর্জিনা, চায়না, শামীমা প্রমুখ বন্ধুর সাথে দীর্ঘদিন দেখা হয় না। কনেজপুরের বিষ্ণু হিন্দু থেকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। যশোর পৌরসভার মেয়র জহিরুল ইসলাম রেন্টুও আমাদের ক্লাসমেট। শুনেছি সে নাকি যশোর পৌর এলাকার উন্নয়নে ভালো কাজ করছে।

সময় বিস্মৃতির আড়ালে লুকিয়ে রাখে সব কিছু। স্মৃতিকাতর মন আমার ধুসর সে সব দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনে স্বর্ণের দীপ্তিতে। প্রায় চার যুগ আগের ঘটে যাওয়া কতশত ঘটনা ভিড় জমায় মনের কোণে।
ক্লাস এইটে বিজ্ঞান ক্লাস নিতেন শাহবুদ্দিন স্যার। একদিন তিনি ক্লাসে ভূমিকম্প নিয়ে আলোচনা করছিলেন। ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্রের নাম সিসমোগ্রাফ নাম উচ্চারণ করতেই পিছনের বেঞ্চ থেকে মেধাবী ও দুষ্ট সিরাজ অদ্ভুতভাবে সিসমোগ্রাফ শব্দটি বলল। সাথে সাথে আরো কয়েকজন। স্যার রেগে গেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কে করেছে। সকলে নীরব। স্যার এবার গর্জে উঠলেন। পিছনের বেঞ্চের কয়েকটি সারির সবাইকে ধোলাই দিলেন আচ্ছা মত। ভাগ্যিস সেদিন আমি প্রথম বেঞ্চে বসেছিলাম।

আরেক দিনের কথা। সেটিও অষ্টম শ্রেণির ঘটনা। শামসুর রহমান স্যার সমাজ ক্লাস নিতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত শান্ত ও নিরেট ভদ্রমানুষ। অল্পভাষী। স্যারের এক সন্তান মারা যাওয়ার তিনি নাকি এমন হয়ে গিয়েছিলেন। সমাজ ক্লাস হত শেষের দিকে। তিনি সেদিন কোনো পড়া ধরলেন না। তিনি বললেন তোমারা যে যা পার লিখ বলে নিজ আসনে বসে রইলেন। কিছুক্ষণ পর খাতা চেক করতে শুরু করলেন। এক এক করে খাতা নিচ্ছে আর বেঞ্চের সামনে দাঁড়িয়েই তা দেখছেন। এবার আমরা পালা। আমার খাতা চেক করতে গিয়ে তিনি অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন। সাজা স্বরূপ তিনি আমার দু’কান ধরে আচ্ছা মত ঝাকালেন। অবশেষে যেন তিনি নিজেই হাপিয়ে উঠলেন এবং আমি রেহাই পেলাম। খাতায় গান লেখার অপরাধে আমি এই শাস্তি পেয়েছিলাম। স্যারের সাথে একবার ঢাকার শেওড়াপাড়ায় দেখা হয়েছিল। তিনি তার এক মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন।

স্কুল ছেড়েছি ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে। সময়ের প্রয়োজনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। স্কুলের বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় অনেকগুলো রুম হয়েছে। বারান্দায় সামনে বেড়ে উঠেছে বড় বড় মেহগুনি গাছ। কিন্তু নেই আমাদের সময়ের কোনো শিক্ষক। থাকবেই বা কীভাবে। সময় যে বয়ে গেছে অনেক। স্কুলের সামনে দিয়ে গেলে চিরচেনা স্কুলকে যেন অচেনা লাগে। ভাবি কোথায় হারিয়ে গেল সেই সব দিন!! কেন হারিয়ে যায় সব!! তবে স্কুল জীবনের কথা খুব বেশি মনে পড়লে গুন গুন করে গেয়ে উঠি-
“দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না–
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।
কান্নাহাসির বাঁধন তারা সইল না–
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি॥”

 

লেখক পরিচিতি : কলামিস্ট ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক।

0 Shares