Home » সারাদেশ » ১১৫০ স্বাভাবিক প্রসব করিয়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পদক পেলেন লিলি

১১৫০ স্বাভাবিক প্রসব করিয়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পদক পেলেন লিলি

 

গোটা বিশ্বে আছে যতো সৎকর্ম মানবপ্রেমই শ্রেষ্ঠ ও পরম ধর্ম । ১১৫০ জন নারীর স্বাভাবিক প্রসব করে রেকর্ড গড়ে জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পদক পেলেন মেহেরুন নেহার লিলি । বর্তমান শীতকাল তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর নিচে – এই তীব্র শীত উপেক্ষা করে স্বাভাবিক প্রসব করতে নারীদের সহায়তা করছেন লিলি ।
দীর্ঘ নয় দশ মাস অপেক্ষার পর সন্তান জন্মদান একটি মায়ের পরম আনন্দের মুহূর্ত, সন্তানের চাঁদ মুখ দেখলেই অতীত সব দুঃখ কষ্ট, ব্যাথা,বেদনা শেষ হয়ে যায় ।
একটা সময় সন্তান প্রসব বলতেই স্বাভাবিক সন্তান প্রসবই ছিল । তবে নানা জটিলতায় অনেক সময় সিজারিয়ান প্রসবের প্রয়োজন পরে । এখন দেখা যাচ্ছে অনেক সময় ব্যবসায়িক স্বার্থে সিজারিয়ান প্রসবের সংখ্যা বাড়ছে । নারীদের অসচেতনতার ফলে সিজারিয়ান প্রসবের প্রবণতা বেড়েছে। এতে তৈরী হচ্ছে নারীদের নানা ধরনের স্বাস্থ্যজটিলতা ও অপমৃত্যু । তবে বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের প্রান্তিক জনপদ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নে কাজিপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে ১১৫৪ স্বাভাবিক প্রসব করে রেকর্ড গড়েছেন স্বাস্থ্যকর্মি মেহেরুন নেহার লিলি।

গত ৯ ডিসেম্বর ২০২৪ আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে – শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী বিভাগে জেলা পর্যায়ে পঞ্চগড় শ্রেষ্ঠ জয়িতা পদক পান মেহেরুন নেহার লিলি । মূলত তার এই মহৎকর্ম কে অনুপ্রেরণা দিতেই এ পুরস্কার প্রদান করা হয় ।

বর্তমানে শিশু জন্মে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ফলে ইনফেকশন ও মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, অঙ্গহানি, জমাট রক্ত ইত্যাদির কারণে মায়েদের সুস্থতা ফিরে পেতে প্রাকৃতিক প্রসবের তুলনায় অনেক দীর্ঘ সময় লাগে।

এছাড়া মায়ের বুকের দুধ পান করার জন্য মায়ের সাথে শিশুর যে শারীরিক নৈকট্যে আসা দরকার সিজারিয়ান হলে সেটি প্রয়োজনের তুলনায় দেরিতে ঘটে। কারণ মায়ের সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য শিশুকে তখন কিছু সময় দূরে রাখা হয়।
একদম শুরুর দিকে মায়ের বুকের দুধের বাড়তি উপকারিতা রয়েছে। তা থেকে সে বঞ্চিত হয়। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার এর মাধ্যমে সন্তান প্রসব করলে প্রসূতি মায়ের মৃত্যুঝুঁকি যেমন থাকে তেমনি ব্যয় হয় অনেক অর্থ।

তবে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের প্রসূতি মায়েদের অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা নেই। যার মূলে রয়েছেন কাজীপাড়া কমিনিটি ক্লিনিক এর সিএইচসিপি মেহেরুন নেহার লিলি। তিনি ২০১১ সালে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার ( সিএইচসিপি) পদে যোগদান করেন কাজীপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে । এরপর ২০১৪ সালে ঠাকুরগাঁও সদর হসপিটাল থেকে কমিউনিটি স্কিল ব্যার্থ অ্যাটেনডেন্ট ( সিএসবিএ) বিষয়ে ৬ মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি ২০১৫ সালে প্রথম নরমাল ডেলিভারি করাতে শুরু করে সফল হন। প্রথমে ভয়ে ভয়ে স্বাভাবিক প্রসব কার্যক্রম শুরু করেন, সফল হলে তার সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এ পর্যন্ত তিনি ১১৫৪ এর অধিক স্বাভাবিক প্রসব করিয়েছেন। যার অধিকাংশই সুবিধাভোগিই হতদরিদ্র, চা শ্রমিক, পাথর শ্রমিক, দিনমজুর, পরিবারের বধূ । এসব স্বাভাবিক প্রসব করাতে তিনি কোন অর্থ নেন না । জমজ স্বাভাবিক প্রসবের রেকর্ড রয়েছে লিলির ।


মেহেরুন নেহার( লিলি) জানান ” আমি আমার দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে মানব সেবার মহান ব্রত নিয়ে এই কাজ করছি। গভীর রাত, বৃষ্টি, ঝড়, তীব্র শীত উপেক্ষা করে যখন একটি ফুটফুটে শিশুর মুখ দেখি তখন সব ক্লান্তি ভুলে যাই। ” তার ফেইসবুক প্রোফাইল স্বাভাবিক প্রসবের হালনাগাদকৃত তথ্য নিয়মিত দেন তিনি – এতে দেখা যায় ঝড় বৃষ্টি, ঈদ,পার্বন কিংবা আধার রাতেও থেমে নেই তার এই অসীম সাহসী কাজ । মেহেরুন নেহার ৩ কন্যা সন্তানের জননী। তার স্বামী মকসেদ আলী, সিএ পদে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত আছেন । মকসেদ আলী জানান ” আমার স্ত্রীর এই মহৎ কাজ করতে সবসময়ই পাশে থেকে সহযোগিতা করেছি, উৎসাহ দিয়েছি, সে অসহায় মানুষের সেবা করছে এতে মৃত্যু ঝুঁকি কমার পাশাপাশি অর্থ ব্যয় থেকে রক্ষা পাচ্ছে, দেশের টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখছে। ‘
সেবা গৃহীতা আকতারা জানান ” শহরে দেখি সিজার করে সন্তান প্রসবের প্রবণতা বেশি, আমার জমজ সন্তান লিলি আপার সহযোগিতায় হয়েছে, এজন্য আমি আজীবন কৃতজ্ঞ, আমাদের সকল মায়েদের আস্থা ভরসার জায়গা করে নিয়েছেন লিলি আপা ”
মেহেরুন নেহার লিলি আরো জানান “যতোদিন সুস্থ আছি প্রান্তিক নারীদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবো। ”

বাংলাদেশ সর্ব উত্তরের সীমান্তবর্তী জনপদ তেঁতুলিয়ার অজপাড়া গাঁয়ে নীরব বিপ্লব করছেন মেহেরুন নেহার লিলি । রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা, সম্মাননা প্রদান করা গেলে সারাদেশে শত লিলি তৈরী হবে । কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোতে লিলি মডেল চালু করাও যেতে পারে । এই ভালো কাজ গুলো ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র ।
এ প্রসঙ্গে মেহেরুন নেহার লিলি বলেছেন-
আলহামদুলিল্লাহ উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে জয়িতা হিসেবে সম্মাননা ক্রেস্ট, সনদ ও উপহার গ্রহণ করলাম।
মহান রাব্বুল আলামিনের অশেষ রহমত ও আপনাদের সবার দোয়া, ভালবাসা,অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় আজ(সোমবার)
পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে “শিক্ষা ও চাকিরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী”ক্যাটাগরিতে নারী উদ্যােক্তা হিসেবে সম্মাননা ক্রেস্ট, সনদ ও উপহার তুলে দেন জেলা প্রশাসক পঞ্চগড় জনাব মোঃ সাবেত আলী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জনাব এসএম ইমাম রাজী টুলু, উপ-পরিচালক মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, পঞ্চগড় জনাব একেএম ওয়াহিদুজ্জামান।

আমি আমার এ অর্জন সবাইকে উৎসর্গ করছি সবার তরে,যারা আমার পথ চলার অনুপ্রেরণা দিয়ে সঙ্গে আছেন ৷

লেখা :আল আমিন – পঞ্চগড়

0 Shares