Home » আন্তর্জাতিক » ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ: ভোজ্য তেলের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক ভারত এখন যে সংকটে

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ: ভোজ্য তেলের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক ভারত এখন যে সংকটে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
গত সপ্তাহে বিশ্বে পাম অয়েলের সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া ঘোষণা করলো যে তারা নিজ দেশে দাম স্থিতিশীল রাখতে এর রফতানি বন্ধ করে দেবে। ইন্দোনেশিয়া জানায়, ইউক্রেনের যুদ্ধ আর কোভিড মহামারির কারণে তাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।বিবিসি

ভারতীয় খাদ্যাভ্যাস এবং রন্ধন-শৈলীতে রান্নার তেল খুবই অত্যাবশ্যকীয় একটা উপাদান। এটি এতটাই দরকারি যে, ভারত রান্নার তেলের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভোক্তা এবং ভেজিটেবল অয়েলের সবচেয়ে বড় আমদানি-কারক। এর ৫৬ শতাংশই আবার তারা আমদানি করে সাতটি দেশ থেকে।

ভারতীয়রা রান্নার জন্য মূলত ব্যবহার করে পাম, সয়াবিন এবং সানফ্লাওয়ার অয়েল। পাম অয়েলের ৯০ শতাংশই আমদানি করা হয় ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া থেকে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক আসে আবার ইন্দোনেশিয়া থেকে।

এই সংকটের এখানেই শেষ নয়। ভারতের অর্ধেক সানফ্লাওয়ার অয়েল আসে রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে। এই দুটি দেশ বিশ্বের মোট সানফ্লাওয়ার অয়েল রফতানির ৮০ শতাংশ জোগান দেয়। একটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সামনের অর্থবছরে সানফ্লাওয়ার অয়েলের সরবরাহ ২৫ শতাংশ কমে যাবে। বিশ্বে পাম অয়েলের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদনকারী দেশ মালয়েশিয়াতেও এর উৎপাদন এবং সরবরাহে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।

এবছর ভারতকে ২০ বিলিয়ন ডলার বা দু্ই হাজার কোটি ডলার খরচ করতে হবে কেবল রান্নার তেল আমদানির জন্য। দুবছর আগে রান্নার তেল আমদানিতে যা খরচ পড়তো, এটা তার দ্বিগুণ।

“কোন দেশেরই এতটা আমদানি নির্ভর হওয়া উচিৎ নয়। আমাদের এখন রীতিমত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এটা একটা বিরাট সংকট। এই যুদ্ধ থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিৎ, আমাদের আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানো উচিৎ”, বলছেন ভারতে ভেজিটেবল ব্যবসায়ীদের বাণিজ্য সংগঠন ‘সলভেন্ট এক্সট্রাক্টর্স এসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক বি ভি মেহতা।

 

বাজার শান্ত রাখতে ভারত রান্নার তেলের ওপর শুল্ক কমিয়েছে। কিন্তু ২০২০ সাল থেকে যেভাবে দাম বাড়ছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এখন সরবরাহ যেভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে, তার ফলে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব বাজারে পাম অয়েলের দাম গত দুবছরে তিনশো শতাংশ বেড়েছে। অথচ দামে সস্তা পড়তো বলে ভারতে লোকজন ঘরের রান্নায় কিংবা হোটেলে, রেস্টুরেন্টে এবং বেকারিতে পাম অয়েলই বেশি ব্যবহার করে।

 

কাজেই ভারতে গত মাসে রান্নার তেলের দাম যে বিশ শতাংশ বেড়ে গেছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। লোকজন রান্নার তেল মওজুদ করতে শুরু করেছে এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের রাস্তায় যেসব মুখরোচক খাবারের এত খ্যাতি, তার বেশিরভাগই ডুবো তেলে ভাজা। ভারতের গরীব মানুষের প্রধান খাদ্য তালিকায় ভাত, গম এবং লবণের মতো রান্নার তেলও একেবারে অপরিহার্য একটা জিনিস।

ভারতের শীর্ষ একজন খাদ্য কর্মকর্তা সুধাংশু পাণ্ডে বলেন, “রান্নার তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় তা আসলেই মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলেছে।”

এর ফলে ভারতে খাদ্য-মূল্য স্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে, গত মার্চে ১৬ মাসের মধ্যে এটি ছিল সর্বোচ্চ, ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ।

জাতিসংঘের খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার খাদ্য অর্থনীতিবিদ ডি ইয়াং বলেন, খাবারের দাম যদি এরকমই চড়া থেকে যায়, তাহলে ভারতে সরবরাহ রেশনিং করতে হতে পারে। “কারণ সরবরাহে যে ঘাটতি পড়েছে, তা মোকাবেলার জন্য এছাড়া আর কোন স্বল্পমেয়াদি পথ নেই”, বলছেন তিনি।

এই ঘাটতি কিছুটা মেটানোর জন্য ভারত এখন এবছরের সর্ষে এবং সয়াবিনের বাম্পার উৎপাদনের ওপর ভরসা করে আছে।

পাণ্ডে বলছেন, “আমাদের দেশীয় উৎপাদন যেহেতু বেড়েছে, তাই বিশ্ব বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপ এখনো ভারতে পুরোপুরি পড়েনি। কারণ বিশ্ব বাজারে রান্নার তেলের দাম যতটা বেড়েছে, ভারতে মূল্য বেড়েছে তার অর্ধেক।”

“কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে কিন্তু এক্ষেত্রে স্বনির্ভর হতেই হবে, এবং এটি তখনই ঘটবে, যখন ভালো দাম পেলে কৃষকরা তেলবীজ উৎপাদনে উৎসাহিত হবে”, বলছেন তিনি।

ভারতের একটি পরিকল্পনা হচ্ছে আরও বেশি পাম গাছ লাগানো। প্রথম বিচারে একটি একটি ভালো পরিকল্পনা বলে মনে হয়। কারণ পাম গাছ থেকে অনেক বেশি তেল পাওয়া যায়, সয়াবিনের তুলনায় প্রায় কয়েকগুণ। পাম অয়েল অনেক বেশি ধরণের কাজেও ব্যবহার করা যায়, রান্না থেকে শুরু করে ভোগ্যপণ্য উৎপাদন, এমনকি শিল্প খাতেও।

কিন্তু পাম গাছে আবার প্রচুর পানি লাগে। আর নতুন পাম গাছ লাগানোর জন্য বিরাট বনাঞ্চল কেটে উজাড় করতে হবে। সরকার প্রস্তাব করছে, নতুন পাম গাছের বাগানের এক তৃতীয়াংশ ভারতের উত্তর-পূর্বের পার্বত্য রাজ্যগুলোতে করা যেতে পারে।

কিন্তু এর বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীরা স্বাভাবিকভাবেই তাদের আপত্তি জানিয়েছে। তারা ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার উদাহরণ টেনে বলছে, কীভাবে এই দুটি দেশকে তাদের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চল ধ্বংসের মতো চড়া মূল্য দিতে হয়েছে প্রধান পাম অয়েল উৎপাদনকারী দেশ হতে গিয়ে।

মিস্টার পাণ্ডে বলছেন, ভারত সরকার দেশে পাম অয়েলের উৎপাদন তিনগুণ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এখন মাত্র ২ দশমিক ৭ শতাংশ পাম অয়েল ভারত নিজ দেশে উৎপাদন করে। তবে এই মুহূর্তে ভারতীয়রা আরও সস্তার রান্নার তেল ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে বলে জানান তিনি।

ভারতে আগে বহু বছর ধরে রান্নার জন্য অঞ্চলভেদে ব্যবহৃত হতো সর্ষে, বাদাম, নারকেল এবং তিলের তেল। কিন্তু নগরায়ন এবং বিশ্বায়নের প্রভাবে ভারতে পাম অয়েল বা সানফ্লাওয়ার অয়েলের মতো বিদেশি রান্নার তেলের ওপর নির্ভরতা তৈরি হয়। এসব তেল দামেও সস্তা, এবং উৎপাদকরা এধরণের তেল বেশি স্বাস্থ্যসম্মত বলে বাজারজাত করে।

“আমাদের রান্নার তেলের এই সংকট আংশিকভাবে আমরা নিজেরাই আসলে সৃষ্টি করেছি, কারণ কিছু গোষ্ঠী সফলভাবে এখানে আমদানি করা ভেজিটেবল অয়েল বিক্রি করেছে” বলছেন খাদ্য ইতিহাসবিদ পৃথা সেন।

অনেকের ধারণা, ভারতে মানুষ যেভাবে আরও বেশি হারে নগরবাসী হচ্ছে, এবং দেশের ভেতরেও মানুষ এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাচ্ছে, তাতে করে আমদানি করা বিদেশি ভোজ্য তেলের ব্যবহার বাড়ছে। কারণ শহরগুলোতে রান্নার কাজে পাম বা সানফ্লাওয়ার অয়েলের মতো রঙবিহীন এবং গন্ধবিহীন তেল বেশি ব্যবহৃত হয়, যাতে করে যে কোন অঞ্চল থেকে আসা মানুষই সেই রান্না খেতে পারে।

“বেশিরভাগ ভারতীয় এখন প্রতিদিন যা রান্না করে, যা খায়, তা খুব একঘেঁয়ে এবং বিস্বাদ খাবার। এর একটা কারণ যে ধরণের তেলে এসব খাবার রান্না করা হয়”, বলছেন খাদ্য বিষয়ক লেখক মারিয়াম এইচ রেশি।

এসব রান্নার তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন ভারতীয়রা বিপদে পড়েছে, কারণ জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে এমনিতেই আগে থেকে তারা সংকটে ছিল।

“ভূমধ্যসাগরীয় খাবার-দাবারে অলিভ অয়েল যেরকম গুরুত্বপূর্ণ, ভারতীয়দের রান্নায় ভেজিটেবল অয়েল ঠিক তাই। দাম হঠাৎ অনেক বেড়ে যাওয়ায় আমাদের রান্নাবান্নার অভ্যাসে এর একটা বিরাট প্রভাব পড়বে”, বলছেন রান্না বিষয়ক একটি অনুষ্ঠানের উপস্থাপক রাকেশ রঘুনাথন।

আবার খাদ্য বিষয়ক লেখক সাদিয়া ঢাইলির ধারণা, এই সংকট হয়তো ভারতীয়দের কম তেলে রান্নায় উৎসাহিত করতে পারে। যদিও অনেক ভারতীয় এখনো অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবারই বেশি পছন্দ করে।

0 Shares