Home » মতামত » ডায়রিয়া : প্রয়োজন সতর্কতা – মোঃ হাবিবুর রহমান

ডায়রিয়া : প্রয়োজন সতর্কতা – মোঃ হাবিবুর রহমান

 

প্রচণ্ড গরমের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এখন ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে চলেছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে খাবার পানির সাথে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সকল এলাকায় ডায়রিয়ার রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। ডায়রিয়া থেকে রক্ষা পাচ্ছে না শিশু ও নারীরাও। সময়মতো চিকিৎসা না দিতে পারলে এটি মারাত্মক হতে পারে, বিশেষ করে শিশুদের ডায়রিয়া প্রতিরোধে বাড়তি সতর্কতা নেয়া প্রয়োজন। কেননা বড়দের চাইতে শিশুদের শরীরের কোষের বাইরের পানি বা এক্সট্রা সেলুলার ফ্লুইড বেশি থাকে। ফলে ডায়রিয়া হলে সহজেই তাদের শরীর পানিশুন্য হয়ে পড়ে। পানিশুন্যতা তীব্র হলে শিশু অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিডনী পর্যন্ত বিকল হতে পারে।

আইসিডিডিআরবি’র সূত্রমতে গত মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরু থেকে গত এক মাসে দেশে ৩০ হাজারেরও বেশি ডায়েরিয়া আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে শিশু ও বয়স্ক মানুষের সংখ্যাই বেশি। গরমকালে ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। ঠিকভাবে পানি ও লবণ পূরণ করা হলে, এটি কখনো গুরুতর আকার ধারণ করে না। বেশির ভাগ ডায়রিয়া এমনিতেই সেরে যায়, কিন্তু ডায়রিয়া হলে ওরস্যালাইন খাওয়া, এমনকি এর চিকিৎসা নিয়ে এখনো রয়ে গেছে কিছু ভুল ধারণা। বিশেষজ্ঞদের মতে উচ্চ রক্তচাপ আছে, এমন রোগীরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে ওরস্যালাইন খেতে বিভ্রান্তিতে ভোগেন। কেননা, স্যালাইনে লবণ আছে, তাদের আশঙ্কা ওরস্যালাইন খেলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। এটি ভুল ধরাণা। প্রতিবার পাতলা পায়খানার সংগে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি ও লবণ বের হয়ে যায়। তা যথাযথভাবে পূরণ করা না হলে, রোগীর পানিশূন্যতা, লবণশুন্যতা, এমনকি রক্তচাপ কমে গিয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে এতে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। ওরস্যালাইনে চিনি বা গ্লুকোজ থাকে, তাই ডায়াবেটিক রোগীরা খেতে ভয় পান। অনেকে মনে করেন, ওরস্যালাইন খাওয়ার পরে ডায়াবেটিক বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ওরস্যালাইনে যে সামান্য চিনি বা গ্লুকোজ আছে, তা অন্ত্রে লবণ শোষণের কাজে ব্যয়িত হয়। সুতরাং ডায়রেরিয়ার সময় ডায়াবেটিক রোগীরা নিশ্চিন্তে ওরস্যালাইন খেতে পারবেন।

স্যালাইন কতোটুকু খেতে হবে, তা নির্ভর করবে কতবার পাতলা পায়খানা হচ্ছে বা কতটুকু পানি হারাচ্ছেন তার ওপর। ডায়রিয়ার কারণে একজন মানুষ মাত্র কয়েক ঘণ্টায় এক থেকে দেড় লিটারের বেশি পানি হারাতে পারেন। সহজ কথা হলো, প্রতিবার পায়খানা হওয়ার পর স্যালাইন খাওয়া এবং অল্প করে সারা দিন বারবার খাওয়া প্রয়োজন। এর বাইরে সারাদিন পানি ও তরল খাবার যেমন-স্যুপ, ডাবের পানি ইত্যাদি খেতে পারলে তা খুব উপকারী। অনেকসময় ফুড পয়জনিংয়ের কারণে বমি বা পাতলা পায়খানা হয়ে থাকে। মানুষ স্বভাবতই ফার্মেসি থেকে বমি বা পাতলা পায়খানা দ্রুত বন্ধের জন্য ওষুধ খান, যা একেবারেই ঠিক নয়। অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া ঠিক না, কারণ পয়জনিংয়ের ক্ষেত্রে বরং কিছু সময় বমি ও পাতলা পায়খানার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ পয়জন বের হয়ে যেতে দিলে তা শরীরের জন্য ভালো। চিকিৎসকের পরমর্শ ছাড়া ডায়রিয়া হলে অ্যান্টিবায়েটিক ঔষধ খাওয়া ঠিক না। কারণ সবক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক জরুরি নয়। ডায়রিয়া হলে সবার আগে প্রয়োজন দেহের লবণ ও পানিশূন্যতা পূরণ করা। প্রয়োজন হলে পরবর্তীতে চিকিৎসকের পরামর্শে ঔষধ খাওয়া যেতে পারে।

ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী বার বার পাতলা পায়খানা করার ফলে তার শরীর থেকে পানি ও লবণ বেরিয়ে যায়। এর ফলে রোগী পানিশূন্য হয়ে পড়ে। সে কারনে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত খাবার স্যালাইন খাওয়ানো আবশ্যক। ডায়রিয়া শুরু হলে আধা লিটার বিশুদ্ধ পানিতে এক প্যাকেট খাবার স্যালাইন ভালোভাবে মিশিয়ে রোগীকে খাওয়াতে হবে। বয়স দুই বছরের নিচে হলে তাদের খাবার স্যালাইন পুরোটাই তৈরি করে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর ১০ থেকে ২০ চা চামচ, দুই বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে ২০ থেকে ৪০ চা চামচ করে যতবার পাতলা পায়খানা হবে, ততবারই খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। যেকোনো ঔষধ এবং পানের দোকানেও এখন খাবার স্যালাইনের প্যাকেট পাওয়া যায়। বানানো খাবার স্যালাইন ৬ (ছয়) ঘণ্টা পর্যন্ত খাওয়ানো যায়। এরপর প্রয়োজন হলে আবার নতুন করে খাবার স্যালাইন বানাতে হবে। শিশুর ডায়রিয়া হলে খাবার স্যালাইনের পাশাপাশি মায়ের বুকের দুধ বেশি করে খাওয়াতে হবে। এছাড়া বড়দের স্বাভাবিক সবধরণের খাবার খাওয়াতে হবে। তবে তরল জাতীয় খাবার বেশি করে খাওয়াতে হবে। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের খাবার স্যালাইনের পাশাপাশি ভাতের মাড়, ডাবের পানি, চিড়ার পানি, লবণ-গুড়ের শরবত, বিশুদ্ধ খাবার পানি খাওয়াতে হবে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য পৃথক ইউনিট খোলা হয়েছে। সেখানে রোগীদের বিশেষভাবে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে সাধারনত বন্যা ও বর্ষন জনিত রোগে আক্রান্ত হয় আমাদের শিশুরা বেশি। আমাদের দেশে সাধারনত ৩(তিন) মাস থেকে ১২(বার) বছরের শিশুরা এ মৌসুমে ডায়রিয়া, কলেরা, জ্বর, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, আমাশয় ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়। কারন একদিকে আবহাওয়ার পরিবর্তন, অন্যদিকে অপ্রত্যাশিত বন্যা ও বর্ষণ। নিরাপদ পানির অভাব ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে এ সময় নিম্ন আয়ের পরিবারের মানুষের মধ্যে এ রোগ বেশি হয়ে থাকে। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে গরিব মা-বাবা শিশুদের যথাযথ যত্ন নিতে পারেনা এবং সে অর্থে পুরোপুরি যত্ন দায়িত্বশীলও হতে পারেন না। প্রায় সময়ই দেখা যায় তারা সঠিক সময় চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে না। ফলে অকালেই মারা যায় অনেক শিশু।

পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, হাত না ধুয়ে কোনো কিছু খেলে বা বাসি, পঁচা খাবার খেলেও ডায়রিয়া হতে পারে। অনেকেই ওয়াসার সরবরাহকৃত লাইনের পানি পান করে। পানির মাধ্যমে ডায়রিয়ার জীবাণু বেশি ছড়ায়। তাই পানি ফুটিয়ে পান করা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। আবার কেউ কেউ রাস্তাঘাটে খোলা ও অস্বাস্থ্যকর খাবার এবং বিভিন্ন ধরণের শরবত খেয়েও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। বারবার পাতলা পায়খানা হলে, বমি হলে, ঝুঁকি না নিয়ে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীকে ভর্তি করাতে হবে।

ডায়রিয়া একটি সাধারন রোগ। আজকাল ডায়রিয়া বা কলেরায় মৃত্যুর হার খুবই কম। কিন্তু আক্রান্ত হলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে, কার্যক্ষমতা কমে যায়। তাই সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যমেরও উচিত ডায়রিয়া প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা ও সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখা। ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে বিশুদ্ধ খাবার পানি এবং টাটকা খাবার খেতে হবে। পঁচা ও বাসি খাবার খাওয়া যাবে না। বাজারের খোলা খাবার খাওয়া যাবে না। বৃদ্ধ ও শিশুদের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে। এ সময় শিশু ও বৃদ্ধদের আঁটসাট পোষাক না পরিয়ে ঢিলেঢালা পোশাক পরাতে হবে। পোশাক সুতির হলে বেশি ভালো হয়। মনে রাখতে হবে ’প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর’। কারণ ডায়রিয়া খুব সাধারণ রোগ হলেও তা মোটেও হেলাফেলার বিষয় নয়। একটু অসতর্কতার কারণে ডায়রিয়ার কারণেই মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কাজেই, ডায়রিয়া প্রতিরোধে সতর্কতা ও সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

প্রোগ্রাম অফিসার, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।
পিআইডি- শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম (৫ম পর্যায়) প্রকল্প কার্যক্রম।

0 Shares