Home » মতামত » যশোরে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চাই

যশোরে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চাই

বি এম ইউসুফ আলী :
যশোর একটি অতি প্রাচীন জনপদ। আনুমানিক ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে পীর খানজাহান আলীসহ বারজন আউলিয়া যশোরের মুড়লীতে ইসলাম ধর্ম প্রচারের প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করেন। ক্রমে এ স্থানে মুড়লী কসবা নামে একটি নতুন শহর গড়ে উঠে ।

আরও পড়ুন :

যশোরের শার্শায় সড়ক দূর্ঘটনায় জীবননেছা বেগম নামে এক নারীর মৃত্যু

যশোরে জন্ম নিল ছাগলের আট পা-ওয়ালা ছানা

১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে যশোর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যশোর-খুলনা-বনগাঁ এবং কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরে অংশ বিশেষ যশোর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে যশোর নাটোরের রাণী ভবানীর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে যশোর একটি পৃথক জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং এটিই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম জেলা। ১৮৬৪ সালে ঘোষিত হয় যশোর পৌরসভা। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে যশোর জিলা স্কুল, ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে যশোর পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে যশোরে বিমান ঘাঁটি নির্মাণ কাজ শুরু করে। ছয় মাসের মধ্যে ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর উপযোগী একটি বিমান বন্দর চালু হয়। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এই বিমান ঘাঁটি সচল ছিল। এরপর ভারত ভাগ হলে ১৯৫০ সালে যশোরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করে। ১৯৫৬ সালে যশোরে পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে যশোরে পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর চালু হয় ১৯৬০ সালে। পিআইএ চট্টগ্রাম, যশোর ও ঈরশ্বদী থেকে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একমাত্র এই যশোর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তরের জন্য সম্প্রসারণের দাবি দীর্ঘদিনের।


বৃহত্তর যশোর উন্নয়ন ও বিভাগ বাস্তবায়ন পরিষদ বিভিন্ন সময় জাতীয় ও স্থানীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করার পাশাপাশি সংবাদ সম্মেলন করে এই দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছে। এর আগে বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যবসায়ী নেতারা যশোর-কলকাতা বিমান চলাচলেরও দাবি জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ী নেতারা সাবেক বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের কাছে স্মারকলিপিও দেন এবং তিনিও তাদেরকে আশ্বস্ত করেন। ২০১৭ সালে ভারতের দিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বেনাপোল বন্দর পরিদর্শনে এসে দুই দেশের যাত্রীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য যশোর-কলকাতা বিমান চালু করা প্রয়োজন বলে বন্দর ব্যবহারকারীদের জানান। কিন্তু আজও যশোর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তরিত করা হয়নি। ফলে এ অঞ্চলের জনগণের দীর্ঘদিনের কাঙ্ক্ষিত দাবি স্বপ্নেই রয়ে গেছে।
প্রিয় পাঠক, যশোর বিমানবন্দর দেশের অন্যতম পুরনো বিমানবন্দর। ঢাকার তেঁজগাও বিমানবন্দর তৈরির পরের বছর যশোর বিমানবন্দর তৈরির কাজ শুরু হয়। এমনকি দেশের একমাত্র বিমান প্রশিক্ষণকেন্দ্র এটি। বর্তমানে প্রতিদিন যশোর বিমানবন্দর থেকে নয়টি বিমান চলাচল করছে। এ ছাড়া কক্সবাজার থেকে চিংড়ি মাছের পোনা নিয়ে এই বিমানবন্দরে প্রতিদিন একাধিক কার্গো বিমান আসা-যাওয়া করে। সবজি ভাণ্ডার যশোর থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন জাতের সবজি ট্রাকে ঢাকায় আসে। ঢাকা থেকে এই সবজির কিছু অংশ বিদেশেও রপ্তানি হয়। যশোর গুড় -পাটালির জন্যও বিখ্যাত। যশোর থেকে বিদেশে কার্গো বিমান চালু হলে সবজির পাশাপাশি যশোরে উৎপাদিত উন্নতমানের ফুল ও খেজুরের গুড়- পাটালি বিদেশে সহজে রপ্তানি করা সম্ভব। তাতে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা যোগ হয় এসকল খাত থেকে।


বাংলাদেশ তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে। এগুলো পদ্মার এপারে। পদ্মার ওপারে বৃহত্তর ফরিদপুর, বৃহত্তর কুষ্টিয়া, বরিশাল বিভাগ ও খুলনা বিভাগের মোট ২১ জেলার মানুষের জন্য কোন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নেই। ফলে ২১ জেলার মানুষকে সম্পূর্ণভাবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উপর নির্ভর করতে হয়। এছাড়া, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নড়াইল, মাগুরা, ঝিনাইদহ জেলার যাত্রীরা যশোর বিমানবন্দর ব্যবহার করেন। কিন্তু যশোর বিমানবন্দরে ছোট অবকাঠামোর কারণে বাড়তি যাত্রীর চাপ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। যশোর বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হলে ২১টি জেলার মানুষ উপকৃত হবে।
দেশকে অর্থনৈতিকভাবে আরও এগিয়ে নিতে বর্তমান সরকার বাংলাদেশে বিভিন্ন জেলায় ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এর মধ্যে ২১ জেলায় ২১টির অধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা রয়েছে। যশোর বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সরাসরি বিদেশ হতে আসা যাওয়া ও পণ্য আনা নেয়া সুবিধা হবে। ঢাকার উপর নির্ভরশীল হতে হবে না।
যশোর হচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তথা খুলনা বিভাগের প্রাণকেন্দ্র ও প্রবেশদার । ঢাকা-কোলকাতা শহরের সংযোগকারী শহর এই যশোর। বৃহত্তর যশোর, বৃহত্তর খুলনা, বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও বৃহত্তর ফরিদপুর হতে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ মানুষ চিকিৎসা, ভ্রমণ, চাকরি ও ব্যবসায়িকসহ নানা কাজে ও প্রয়োজনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করে। দ্রুত যাতায়াতের ক্ষেত্রে তাদেরকে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করতে হয়। যে কারণে অতিরিক্ত সময়, শ্রম ও অর্থের অপচয় হয় এবং রাজধানী ঢাকার উপর অনেক চাপ পড়ে। যশোর বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হলে উপরিউক্ত সমস্যাগুলো সহজেই সমাধান হতে পারে।
শিল্পনগরী নওয়াপাড়ায় নৌবন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের মত গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক জোন রয়েছে এই জেলায়। বেনাপোল স্থলবন্দর ও যশোর কাস্টম হাউস প্রতিবছর সাত হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে। যশোরের সঙ্গে নোয়াপাড়া নৌ বন্দর, বেনাপোল বন্দর, মোংলা বন্দরের সহজতর সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা রয়েছে। বিদেশ থেকে এই বন্দর ব্যবহারকারীরা বিমানে ঢাকা হয়ে যশোরে আসে।এখানে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলে এ অঞ্চল তথা সমগ্র বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে আরও সমৃদ্ধ হবে।
প্রতি বছর এ অঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার মানুষ হজব্রত পালন করতে সৌদি আরব যায়। এদের একটা বড় অংশ বয়স্ক ও বৃদ্ধ। তাদের জন্য ঢাকা হয়ে সৌদি আরবে গিয়ে হজ্জ করে আবার ফিরে আসা অত্যন্ত কষ্টকর এবং অর্থের অপচয় হয়। যশোর বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হলে তাদের কষ্ট অনেক লাঘব হবে এবং অর্থও বাঁচবে।
বর্তমান সরকারের একটি বড় অবদান পদ্মাসেতু।নির্মাণাধীন পদ্মাসেতু চালু হবার পর দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দু হবে যশোর। এখানে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলে ২১টি জেলার মানুষ যে সুবিধা পাবে, যশোর ছাড়া অন্য কোন জেলায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলে এ অঞ্চলের প্রচুর মানুষ সেই সুবিধা হতে বঞ্চিত হবে।
একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রক্ষণাবেক্ষণের কাজে প্রচুর দক্ষ জনবল ও অর্থ প্রয়োজন হয়। যশোরে বিমান বাহিনীর ঘাঁটি থাকার কারণে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বিমান বাহিনী খুব সুন্দরভাবেই করতে পারবে এবং সরকারের অর্থ সাশ্রয় হবে।
যশোর বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মুক্ত ও কম ভূমিকম্পন প্রবণ এলাকা। এখানে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আন্তর্জাতিক বিমান ওঠা নামার ক্ষেত্রে কোন প্রকার বাধাপ্রাপ্ত হবে না।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন , নীল বিদ্রোহ, তে-ভাগা আন্দোলন, কৃষক সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে যশোরবাসী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা যশোর এবং প্রথম ডিজিটাল জেলাও যশোর। বৃহত্তর যশোরের ঐতিহ্য, অবদান, প্রশাসনিক অবকাঠামো, ভৌগোলিক অবস্থান, প্রকৃতিক, পরিবেশ এবং প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি যশোর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তরিত করা জরুরি।
লেখক পরিচিতি : কলামিস্ট ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
bmyusuf01@gmail. com

0 Shares