Home » মতামত » স্বপ্নের জন্য প্রযুক্তি -ইমদাদ ইসলাম

স্বপ্নের জন্য প্রযুক্তি -ইমদাদ ইসলাম

সদ্য স্বাধীন দেশের দায়িত্ব যখন বঙ্গবন্ধু কাঁধে নিয়েছিলেন তখন হাজারো সমস্যা তার সামনে এসে হাজির। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শূন্য। জিডিপির তুলনায় সঞ্চয়ের অনুপাত কম বেশি তিন শতাংশ। আর বিনিয়োগ এর অনুপাত নয় শতাংশের আশেপাশে। শুধু তাই নয় দেশে উদ্যোক্তা শ্রেণি বলতে ছিলই না।অনেক আগে থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পরিকল্পিতভাবে এদেশে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো।যার ফলে এ দেশে নিজস্ব তেমন কোনো উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়নি।মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পোপতিরা এদেশে তাদের শিল্প কলকারখানা অরক্ষিত রেখেই পাকিস্তানে চলে যায়। তাই ঐ সময় ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্প কলকারখানা মুখথুবড়ে পড়ে।বঙ্গবন্ধু বড়ো বড়ো শিল্প কলকারখানা পরিচালনার জন্য দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।কিন্তু সমস্যা দেখা গেলো এসব কলকারখানা পরিচালনার জন্য দেশীয় কোন উদ্যোক্তা পাওয়া গেল না।অনেকটা নিরুপায় হয়েই তিনি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় শিল্প কলকারখানা চালুর উদ্যোগ নিলেন। এসময় শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিলো। নানা রকম সমস্যার মধ্যেও সরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বেকারত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ সীমা ২৫ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকায় উন্নতি করেছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প কলকারখানা পর্যায়ক্রমে ব্যক্তিখাতে হস্তান্তরের পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর হাতেই স্বাধীন বাংলাদেশের শিল্প কলকারখানার যাত্রা শুরু হয়েছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার শিল্পায়ন বা শিল্পখাতকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচনা করে দেশের শিল্পায়নের গতিকে বেগবান করতে শিল্পনীতি ২০১৬ ঘোষণা করেছে। এ নীতিতে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা,নারীদের শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার মূলধারায় নিয়ে আসা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে পুঁজিঘন শিল্পের পরিবর্তে শ্রমঘন শিল্প স্হাপনকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে শিল্পনীতিতে নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণসহ কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকার সমস্যা সমাধানের একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে গণ্য করা হয়ে থাকে। ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত এবং সম্প্রসারণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও এ খাত প্রসংসনীয় অবদান রাখছে। সম্ভবনাময় এ খাতের মাধ্যমে স্বল্প আয়ের জনগণের জীবনমান উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারী পুরুষের বৈষম্য নিরসনের জন্য সরকার ইতোমধ্যে নানারকম পদক্ষেপ প্রহণ করেছে।এ শিল্পের বিকাশের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান সহজ শর্তে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি ঋণ বিতরণসহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য মফস্বলভিত্তিক শিল্প স্হাপনে পুনঃঅর্থায়ন স্কিম, স্মল এন্টারপ্রাইজ খাতে পুনঃঅর্থায়ন স্কিম, এবং জাইকার অর্থায়নে ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর প্রজেক্ট ফর দ্যা ডেভেলপমেন্ট অব স্মল এন্ড মিডিয়াম সাইজড এন্টারপ্রাইজেস প্রকল্পের আওতায় দ্বি-ধাপ তহবিলের মাধ্যমে পুনঃ অথবা পূর্ব অর্থায়ন স্কিম থেকে পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা চালু রয়েছে। এছাড়াও নতুন উদ্যোক্তাদের স্টার্টআপ তহবিল সরবরাহের জন্য কটেজ মাইক্রো ও ক্ষুদ্র খাতে নতুন উদ্যোক্তা পুনঃঅর্থায়ন তহবিলসহ অন্যান্য ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহজ শর্তে ঋণ বিতরণে বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। বিবিএস এর হিসাব অনুযায়ী জিডিপিতে শিল্পখাতের অবদান শতকরা ৩৫ শতাংশেরও বেশি।
শুধু শিল্পনীতিমালা, উদ্যোক্তা এবং অর্থসংস্হানের ব্যবস্হা করলেই শিল্পায়ন হবে না। এজন্য আরও অনেক কিছু প্রয়োজন।এরমধ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন ও দক্ষ জনবল অন্যতম।শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার ইতিমধ্যে নানারকম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।এছাড়াও দক্ষ জনবল তৈরি করার জন্য বাংলাদেশ শিল্প ও কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র ( বিটাক) এর সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ আধুনিকায়ন করা হয়েছে। বিটাকের মূল কাজ হলো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ কারিগরি জনবল সৃষ্টি করে শিল্প ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি আহরণ ও হস্তান্তরসহ শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন বিষয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান সমূহকে পরামর্শ প্রদান করা। প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্র- ছাত্রীদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান উপযোগী করে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণে সহযোগিতা করা। দেশি-বিদেশি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাথে কারিগরি সহায়তার আওতায় উদ্যোক্তা তৈরি এবং দেশীয় প্রযুক্তি উদ্ভবনের জন্য ইনকিউবেশন সেন্টার স্হাপন,গবেষণার মাধ্যমে উন্নতমানের পণ্য অথবা প্রযুক্তি উদ্ভাবনপূর্বক হস্তান্তর। খুচরা যন্ত্র অথবা যন্ত্রাংশ তৈরি ও মেরামতপূর্বক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কার্যক্রমে গতিশীলতা আনায়ন।এছাড়াও প্রশিক্ষণ,পরামর্শ, প্রযুক্তি হস্তান্তর, যন্ত্র অথবা যন্ত্রাংশের টেস্টিং ফ্যাসিলিটি ইত্যাদি কার্যক্রমের সাহায্যে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করা।সেমিনার, দলবদ্ধ আলোচনা, প্রকাশনা,প্রদর্শনী,শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সরকারি -বেসরকারি সকল উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট জ্ঞানের প্রসার ঘটানো। কারিগরি ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি সংস্থার সাথে প্রশিক্ষণ,গবেষণা, প্রযুক্তি হস্তান্তর, যন্ত্রপাতি পরীক্ষা ও কারিগরি পরামর্শ বিষয়ক কাজে যৌথ কারিগরি সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্হাপন।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সরকারের ভিশন ২০২১, এসডিজি ২০৩০ এবং ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রযুক্তি উন্নয়ন ও হস্তান্তর এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির জন্য বিটাকের কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ২০১৬-২০২১ মেয়াদে ৭৭.২২ কোটি টাকা ব্যয়ে বিটাকের প্রধান কার্যালয়ে নতুন ১০ তলা ভবন এবং আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ টুল এন্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউট (টিটিআই) স্হাপন করা হয়েছে। এই ইনস্টিটিউটে সাম্প্রতিক বিশ্বের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির উপর প্রশিক্ষণ,গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে শিল্পের কারিগরি সমস্যা, সমাধান, প্রযুক্তি হস্তান্তর,লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরের জন্য টেস্টিং ও কমন ফ্যাসিলিটি স্হাপনের মাধ্যমে কারিগরি সহায়তা প্রদান এবং নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং শিল্পক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য স্হানীয়ভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং সাপোর্ট প্রদানের লক্ষ্যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বুয়েটসহ বাংলাদেশ কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি তাদেরকে বাস্তব জীবনের প্রশিক্ষণ ও কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করে কর্মক্ষেত্রে সফল জনবল তৈরিতে বিটাকের টুলস এন্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউট (টিটিআই) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।তারা এবিষয়ে বর্তমান শিল্পের চাহিদার আলোকে নয়টি গুরুত্বপূর্ণ কোর্স পরিচালনা করছে। ঢাকা ছাড়াও বিটাকের চট্টগ্রাম, খুলনা, চাঁদপুর ও বগুড়াতে আঞ্চলিক কেন্দ্র রয়েছে। এসকল কেন্দ্রেও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনবল গড়ে তোলা হচ্ছে। দেশে ৪৬ হাজার ১১০ টি শিল্প কলকারখানা চালু রয়েছে। এর মধ্যে বড়ো শিল্পকলকারখানা রয়েছে ২ হাজার ৮৫৬ টি,মাঝারি শিল্পের সংখ্যা ৩ হাজার ১৭৮ টি,ক্ষুদ্র শিল্প কারখানা আছে ২৩ হাজার ৩০৬ টি এবং অতিক্ষুদ্র শিল্পের সংখ্যা ১৬ হাজার ৭৭০ টি।এসব শিল্পের মোট স্হায়ী সম্পদের পরিমাণ কম বেশি ২ লাখ ৪৪ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা।
প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চতুর্থশিল্প বিপ্লবের উপযোগী শ্রমশক্তি তৈরি করে প্রযুক্তির সহায়তায় ২০৪১ এ উন্নত বাংলাদেশ গঠন করাই বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। সে লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে প্রযুক্তি নির্ভর দক্ষ জনবলের তৈরির জন্য কাজ করছে।
পি. ফি.

 

0 Shares