Home » জীবনধারা » হিজড়াদের জীবন ধারণ : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ -মো.নাসির উদ্দিন খোন্দকার

হিজড়াদের জীবন ধারণ : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ -মো.নাসির উদ্দিন খোন্দকার

 

হিজড়া শব্দটি এসেছে আরবি হিজরত বা হিজরী শব্দ থেকে যার আভিধানিক অর্থ পরিবর্তন বা migrat বা transfer। ট্রান্সজেন্ডার বলতে এমন এক লৈঙ্গিক অবস্থাকে বুঝায়, যা দৈহিক বা জেনিটিক কারণে মেয়ে বা ছেলে কোন শ্রেণিতে পড়ে না। নারীও নয় আবার পুরুষও নয়-এধরনের একটি শ্রেণিকে আমরা প্রায়ই রাস্তা-ঘাটে কিংবা দোকানপাটে বিভিন্ন রকম অঙ্গভঙ্গি করে চাঁদা তুলতে দেখি। আমরা যারা সভ্য সমাজের মানুষ, তারা এই অবহেলিত শ্রেণিটিকে ‘হিজড়া’ বলে ডাকি।

 

 

আরও পড়ুন :

বরিশালে নতুন ৩ জন করোনা আক্রান্ত

ঢাকার প্রথম মসজিদ

চিকিৎসকরা জানান, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু এক্স-এক্স প্যাটার্নে কণ্যা শিশু আর এক্স-ওয়াই প্যাটার্নে পুত্র শিশুর জন্ম গ্রহণ করে। জরায়ুতে ভ্রুণের বিকাশ হওয়ার সময় মায়েদের বিভিন্ন প্রকার শারীরিক ও মানুষিক সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে।

ভ্রুণের পূর্ণতার স্তরগুলোতে ক্রোমোজোম প্যাটানের প্রভাবে ছেলে শিশুর মধ্যে অণ্ডকোষ, আর কন্যা শিশুর মধ্য ডিম্বকোষ জন্ম নেয়। ডিম্বকোষ থেকে নিসৃত: হয় পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন এবং ডিম্বকোষ থেকে নিসৃত হয় এস্ট্রোজেন। ভ্রুণের বিকাশকালে নিষিক্তকরণ ও বিভাজনের ফলে এক্স-এক্স-ওয়াই অথবা এক্স-ওয়াই-ওয়াই এর মতো বেশ কিছু অস্বাভাবিক প্যাটানের সৃষ্টি হয় ফলে বিভিন্ন গঠনের হিজড়া শিশুর জন্ম হয়।

প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে একটি চক্র সরল সুন্দর সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির বার-তেরো বছরের ছেলেদের বিভিন্ন প্রলোভনে প্রতারণায় ফেলে নিয়ে যায়। হাসপাতাল বা ক্লিনিকে শিক্ষিত ডিগ্রিধারী অসাধু ডাক্তারদের মাধ্যমে তাদের পুরুষাঙ্গ কেটে, ওষুধ খাইয়ে আকৃতি বিকৃত করে, ইনজেকশন দিয়ে বা অপারেশন করে তাদের স্তন বড় করে হিজড়ার খাতায় নাম লেখায় এবং পরে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, পতিতাবৃত্তির মতো জঘন্য অপরাধে জড়িত হয় এরা। ইচ্ছে করলেও বাড়ি ঘরে ফিরে যেতে পারে না। ফ্যামিলি এবং সমাজ থেকে দূরে থেকে যাচ্ছে তাই করে বেড়ায়।

অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলাম ধর্ম সব মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেছে। ইসলাম হিজড়াদের অন্য সব মানুষের মতো একজন মানুষ হিসেবে দেখেছে। পুরুষ হলে পুরুষের, নারী হলে নারীর বিধান মেনে চলতে হবে তাদের। একজন নারীর যেমন নামাজ, রোজা ও পর্দাসহ ইসলামের সব বিধান মানতে হয়, একজন নারী হিজড়াকেও এগুলো মেনে চলতে হয়। এভাবে পুরুষের মতো পুরুষ হিজড়াকেও মানতে হয় পুরুষদের জন্য জীবন বিধান। মৃত সাধারণ মানুষের মতো তাদেরও কাফন, দাফন ও জানাজা দিয়ে কবর দেয়ার হুকুম রয়েছে ইসলাম ধর্মে।

করোনা মহামারিতে তাদের জন্য কাজের নির্দিষ্ট কোনো সংস্থান না থাকায় তারা খাদ্যাভাবে ভুগছে, যদিও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা হিজড়াদের পাশে দাঁড়িয়েছে, যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল তথাপি সারাদেশের মানুষ যদি তাদের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে হিজড়া জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে। প্রধানমন্ত্রী যদিও তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়ও কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন।

২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে মন্ত্রিসভা সরকারি ইশতেহারে তৃতীয় লিঙ্গকে এই বলে স্বীকৃতি প্রদান ও তালিকাভুক্ত করে যে, “বাংলাদেশ সরকার হিজড়া সম্প্রদায়কে হিজড়া লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।” এই ঘোষণা বাংলাদেশের হিজড়া সম্প্রদায়ের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতো। এ প্রজ্ঞাপনের পর হিজড়া সম্প্রদায়কে জন্মের সময় পুরুষ এবং পরবর্তীতে মহিলা পরিচয়ে চিহ্নিত করা হয়, তারা নিজেদের হিজড়া অথবা একটি তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয়ে পরিচয় দিতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় হিজড়াদের সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করতে আবেদন জানায়, যা এ সম্প্রদায়ের জন্যএকটি বিরাট ব্যাপার, কারণ এর আগে তারা ভিক্ষাবৃত্তি, বিভিন অনুষ্ঠানে গান-বাজনা, যৌন কর্মের মাধ্যমে জীবনযাপন করত এবং যারা সুরক্ষার জন্য হিজড়া দল নেতার (গুরু) উপর নিভর্রশীল ছিল।

হিজড়া জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও আবহমানকাল থেকে এ জনগোষ্ঠী অবহেলিত ও অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এ জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, সর্বোপরি সমাজের মূল স্রোত ধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদেরকে সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে সরকার এ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সমাজসেবা অধিদফতরের জরিপ মতে বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার।

২০১২-২০১৩ অর্থবছর হতে দেশের ৭টি জেলা ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, পটুয়াখালী, খুলনা ,বগুড়া এবং সিলেটে পাইলট কর্মসূচি হিসেবে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কর্মসূচি শুরু হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এ বাবদ বরাদ্দ ছিল ৭২,১৭,০০০ (বাহাত্তর লক্ষ সতের হাজার) টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নতুন ১৪টি জেলাসহ মোট ২১টি জেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে : ঢাকা, গাজীপুর, নেত্রকোণা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষীপুর, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, কুমিল্লা, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, পিরোজপুর, পটুয়াখালী এবং সিলেট। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ ছিল ৪,০৭,৩১,৬০০ (চার কোটি সাত লক্ষ একত্রিশ হাজার ছয়শত টাকা), ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে এ কর্মসূচি বরাদ্দ ছিল ৪,৫৮,৭২,০০০.০০ (চার কোটি আটান্ন লক্ষ বাহাত্তর হাজার) টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ কর্মসূচি ৬৪ জেলায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৪ জেলায় বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ১১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ ক্ষেত্রে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৫,৫৬,০০,০০০/- (পাঁচ কোটি ছাপ্পান্ন লক্ষ) টাকা।

এ কর্মসূচির আওতায় স্কুলগামী হিজড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৪ স্তরে (জনপ্রতি মাসিক প্রাথমিক ৭০০, মাধ্যমিক ৮০০, উচ্চ মাধ্যমিক ১০০০ এবং উচ্চতর ১২০০ টাকা হারে) উপবৃত্তি প্রদান করাসহ ৫০ বছর বা তদুর্ধ বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের বিশেষ ভাতা জনপ্রতি মাসিক ৬০০ প্রদান এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম হিজড়া জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয় বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে তাদের সমাজের মূলস্রোত ধারায় আনাসহ প্রশিক্ষণোত্তর আর্থিক সহায়তা ১০,০০০/-( দশ হাজার) টাকা করে প্রদান করা।

গণমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে হিজড়াদের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। বিপুল সংখ্যক হিজড়ার বেশির ভাগ সামাজিক সুবিধা ও শৃঙ্খলার বাইরে। একদিকে তারা যেমন মানবেতর জীবনযাপন করছে, অন্য দিকে জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা অনেক ক্ষেত্রে অমানবিক হয়ে উঠছে। আশার কথা হলো, বাংলাদেশ সরকার তাদের সামাজিকীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার অংশ হিসেবে ২০০৮ সালে তৃতীয় লিঙ্গের লোকেরা ভোটাধিকার পায় এবং ১১ নভেম্বর ২০১৩ মন্ত্রিসভা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে হিজড়াদের সামাজিক স্বীকৃতি দেয়। শিক্ষা অধিদপ্তর ২০১২ সাল থেকে হিজড়া শিশুদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি চালু করেছে। এ ছাড়া তাদের নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা উন্নয়নমূলক কাজ করছে। এসব উদ্যোগের ফলে হিজড়া সম্প্রদায়ের মধ্যেও সমাজের মূল ধারায় অঙ্গীভূত হওয়ার উৎসাহ চোখে পড়ছে। জীবন উন্নয়নে তাদের কেউ কেউ নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে, যা সত্যিই প্রশংসনীয়। সোনার বাংলায় সব জনগোষ্ঠীর মানুষ সুখে শান্তিতে মর্যাদা নিয়ে বসবাস করবে। সকলের সম্মিলিত প্রয়াস এবং প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাবে দেশ দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে।
-০০-
(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম বিষয়ক ফিচার)

0 Shares