Home » Uncategorized » একুশ থেকে স্বাধীনতা – এম. এ. হান্নান

একুশ থেকে স্বাধীনতা – এম. এ. হান্নান

একুশ থেকে স্বাধীনতা – এম. এ. হান্নান “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি?” বাংলাদেশের আর দশ জনের মতই আমারও ঘুম ভাংতো মোরগ-ডাক ও পাখির কলকাকলিতে। ঘুম থেকে জেগেই ডাকতাম, “মাগো, কিছু খেতে দাও, মিছিলে যাব।” ভাষা আন্দোলনের মিছিল। মিছিলের কথা এজন্য বলছি, সে সময় স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির ছাত্ররা ফেব্রুয়ারি মাসে বাসায় নির্জীবের ন্যয় বসে থাকতে পারতো না। যারা সংগঠকের ভূমিকায় থাকতাম তাদের তো দম ফেলার সময় মিলতো না। এভাবেই সারা দেশের ন্যায় একুশের ঢেউ ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র। বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের থানা তেঁতুলিয়া, যে থানাকে হিমালয় কন্যা বলে অভিহিত করা হয়, সেখানেও একই অবস্থা, ভাষা-আন্দোলনের হাওয়া। আমরা বাঙ্গালি, বাংলা মোদের মায়ের ভাষা। জন্মলগ্ন থেকে আমরা মায়ের কাছে যে ভাষা শিখেছি, প্রাণপ্রিয় সেই ভাষা বড় হবার সাথে সাথে আমাদের রক্ত-মাংস, নাড়ি ও হৃদয়ের সাথে মিশে গেছে। মা-বাবা ছাড়াও আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, আপনপর সবার সাথে আমরা অবিরত যে ভাষায় কথা বলি হৃদয় থেকে সেটি কি কখনো ছিনিয়ে নেয়া যায়? প্রতিদিন সন্ধ্যা আসতে না আসতে পাখিরা নীড়ে ফিরে কিচিরমিচির করে, আবার ভোর হলে একই অবস্থা। বক-ঘুঘু-কবুতর, পোষা কুকুর-বিড়াল, ছাগল-ভেড়া, গরু-মহিষ, এমনকি বনের সকল পশুপাখি, জীবজন্তু সবাই তো নিজের ভাষায় কথা বলতে চায়, অথবা বিশেষ ভাব-ভঙ্গিমায় ভাবের আদান-প্রদান করে, করতে চায়। মনের আকুতি অন্যের নিকট পৌঁছানোর এটিই তো প্রকৃতিগত একমাত্র ব্যবস্থা। কেউ যদি এটি কেড়ে নিতে চায়, ভাবুন তো এটি কত বড় অপরাধ, অন্যায়, অমানবিক? বহু ত্যাগ তীতিক্ষার বিনিময়ে ব্রিটিশের কাছ থেকে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট আমরা স্বাধীনতা পেলাম। অখণ্ড ভারতবর্ষকে ভাগ করে গঠিত হলো দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে বিচিত্র ও কৃত্রিম (peculiar & artificial) এক রাষ্ট্র। নাম তার পাকিস্তান। রাষ্ট্র হলো একটি, কিন্তু ভূখণ্ড হলো দু’টি। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। এ দু’টির দূরত্ব এক হাজার দুই শত মাইল। দু’খণ্ডে বসবাসকারী জনগণের ভাষা,কৃষ্টি-কালচার,খাওয়া- দাওয়া,আচার-আচরণ,পৌষ-পার্বণ,পোশাক-পরিচ্ছদ, বেশ-ভূষা, সাহিত্য- সংস্কৃতি সব কিছুই আলাদা। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন দক্ষিণ ভারতের ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সম্মেলনে একটি অবাস্তব-অসংগত বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন-“ পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।” পরের সপ্তাহেই তার এ কথার জবাবে জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্র সুদৃঢ সুস্পষ্ট বক্তব্যটি ছিল-“ পাকিস্তান ডোমিনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসিদের মাতৃভাষা বিভিন্ন; যেমন- পশতু,বেলুচী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী এবং বাংলা। কিন্তু উর্দু পাকিস্তানের কোন অঞ্চলেই মাতৃভাষারুপে চালু নেই। ——– যদি বিদেশী ভাষা বলিয়া ইংরেজী ভাষা পরিত্যাক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ না করার পক্ষে কোন যুক্তি নেই। যেহেতু পাকিস্তানের ৩% মানুষ উর্দুতে এবং ৫৬% মানুষ বাংলায় কথা বলেন।” উল্লেখ্য, ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ সালে করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার বৈঠকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার প্রস্তাব উঠলে তৎকালীন কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ঘোরতর আপত্তি তুলে বাংলা ভাষাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। অথচ তার এ কথার কর্ণপাত করা হলো না। ডক্টর জিয়াউদ্দিনের সেই অসংগত ও বাস্তবতাবর্জিত ‘রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার প্রস্তাব’ নিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্র প্রধান তথা ‘গভর্নর জেনারেল’ কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্; ১৯৪৮ সালে ঢাকায় এলেন। উল্লেখ্য যে, সে সময় পাকিস্তানের সর্বমোট জনসংখ্যার ৫৬ ভাগের বসবাস ছিল পূর্ব পাকিস্তানে, যার অধিকাংশই ছিল বাঙ্গালি। যাদের সকলের ভাষা ছিল বাংলা। অবশিষ্ট ৪৪ ভাগ মানুষ বাস করতো পশ্চিম পাকিস্তানে। যাদের ভাষা ছিল পাঞ্জাবি, পস্তু, সিন্ধি এবং বেলুচি। আবার অনেকে কাশ্মিরি, ব্রাহুই, সিনা, হিন্ডকো এবং শারাইকি আঞ্চলিক ভাষাতেও কথা বলতেন। এক জরিপে দেখা যায়, ১৯৫১ সালে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু ভাষায় মাত্র ৭ ভাগ মানুষ কথা বলতেন। অর্থাৎ পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩ ভাগ লোক উর্দুতে কথা বলতেন। কাজেই এদেশে বিশেষকরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে উর্দু জোর করে চাপিয়ে দেয়া ছিল একটি অমার্জনীয় অপরাধ। আর জিন্নাহ ; সাহেব সেই অপরাধটিই করতে সচেষ্ট হলেন। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক নাগরিক সম্বর্ধনা সভায় এবং ২৪ মার্চ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তিনি ঘোষণা করলেন, “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”–(” Urdu and only Urdu shall be the state language of Pakistan “)। তার এ ঘোষণায় এদেশের ছাত্র-শিক্ষক, সুধী এবং শিক্ষিত সমাজ একবাক্যে আপত্তি জানিয়ে বললেন, “না, না, না, তা’ হতে পারে না। ((No, no, no, impossible.”| । যেহেতু এদেশের ৫৬% মানুষ বাংলা ভাষায় এবং মাত্র ৩% মানুষ উর্দুতে কথা বলেন, কাজেই বাংলাই হবে, হতে পারে, হওয়া উচিৎ এদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা,উর্দু নয়। অতঃপর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বাঙ্গালির মায়ের ভাষাকে কেড়ে নেয়ার আর এক কৌশল বা নতুন ফাঁদ পাতলেন। তারা চাইলেন বাংলা লেখা বাংলা হরফের পরিবর্তে আরবি আরবি হরফে লিখতে হবে। (“The central government proposed to write the Bengali language in Arabic script. ” ) এ এক অদ্ভুত প্রস্তাব। বাংলা ভাষাকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র। উল্লেখ থাকে যে, ভাষা আন্দোলনের পুরোধায় ছিলেন এদেশের ছাত্র সমাজ এবং সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান তমদ্দুন মজলিস। ভাষা আন্দোলনের ১৯৪৮এর ১১ মার্চ ছিল একটি স্মরণীয় দিন। এ দিনে মিছিল করতে গিয়ে শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিব, শামসুল হক, অলি আহাদ সহ অনেক ছাত্রনেতা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। ছাত্রনেতা আব্দুল মতিন এবং আব্দুল মালেক উকিল সহ অসংখ্য নেতা-কর্মি মিছিলে অংশ নেন। মোহাম্মদ তোয়াহা মারাত্মকভাবে আহত হন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই কমিউনিস্টদের অনেককে মাথায় হুলিয়া নিয়ে ’আন্ডারগ্রাউন্ডে’থেকে সকল আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হতো। বাংলা এবং উর্দুকে সমান মর্যাদা দেয়ার প্রথম প্রস্তাবটি দেয়া হয়েছিল কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকেই। ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ এর অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতা মোহাম্মদ তোয়াহা এবং আব্দুল মতিন ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ১৯৫২’র ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বার লাইব্রেরি হলে মৌলানা ভাষানীর সভাপতিত্বে ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ’ গঠিত হলো। সরকারের এহেন আজগুবি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে এদেশের ছাত্র- শিক্ষক এবং সকল স্তরের জনগণ আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। বাংলা ভাষা সমুন্নত রাখার যৌক্তিক দাবির আন্দোলন সংগ্রামকে ভণ্ডল করার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হলো। আন্দোলন-সংগ্রামরত ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নিল। আন্দোলনের এক পর্যায়ে পুলিশ ছাত্রদের উপর বেপরোয়া গুলি চালালো। শহীদ হলো সালাম, রফিক, বরকত এবং জব্বার সহ আরো অনেকে। আহত হলো অসংখ্য ছাত্র-জনতা। সংবাদটি সাথে সাথে বারুদের মত সারা ঢাকা শহরে এবং অতঃপর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লো। ফুসে উঠলো সারা দেশের মানুষ। পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের ‘ট্রেজারি- বেঞ্চ’ এর মৌ. আ. রশিদ তর্কবাগীশ, শরফুদ্দিন আহমেদ, শামসুদ্দিন আহমেদ খন্দকার এবং মশিহ্উদ্দিন আহমেদ ছাড়াও মনোরঞ্জণ ধর, বসন্তকুমার দাস, শামসুদ্দিন আহমেদ এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সহ আরো অনেক আইন পরিষদ সদস্য ‘চীফ মিনিস্টার’ নূরুল আমিনকে অনুরোধ জানালেন, ভাষা আন্দোলনের এই দুর্ঘটনায় শহীদদের প্রতি শোক বা দুঃখ প্রকাশ করে ‘এ্যাসেম্বলী’ মূলতবি রেখে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের সমবেদনা জানাতে দেখতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু অত্যন্ত দুখেঃর বিষয়,‘চীফ মিনিস্টার’ তাদের সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন! ফলতঃ বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলন-সংগ্রাম আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগলো। ২২ ফেব্রুয়ারি,১৯৫২ : একুশের পরের দিনেও ১৪৪ ধারা জারি করা হলো, যাতে জনতা ‘জানাজা’ ও শোকের মিছিলে অংশ নিতে না পারে। কি মর্মান্তিক এবং অমানবিক শাসন-নির্যাতন! পুলিশের বাধা অমান্য করে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে হাজার হাজার জনতা শহরের চারদিক থেকে মিছিলে মিছিলে যোগ দিতে লাগলো মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ চত্তরে। এ মিছিলে শুধু ছাত্র ও রাজনীতিবিদরা ছিল না, ছিল বিভিন্ন সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, সরকারি বেসরকারি অফিসের চাকরিজীবী। রেডিও স্টেশন এর কর্মি-কর্মকর্তারাও অফিসের কাজ-কর্ম বন্ধ রেখে এ শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল চত্তর ও মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাস লাখো মানুষের ভীরে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। সেদিনও ওসমানী উদ্যান সংলগ্ন নওয়াবপুর রোড এলাকায় মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালালে শহীদ হলো সফিউর রহমান ও নয় বছরের বালক ওহিউল্লাহ্ধসঢ়;। আহত হলো বহু মানুষ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা রাতারাতি মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল এর পাশে গড়ে তুললো শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ। স্মৃতি স্তম্ভ উদ্বোধন করলেন শহীদ শফিউরের পিতা। ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সেটি ভেঙ্গে দিলে ছাত্র-জনতা ক্রোধে ফেটে পড়লো। [ উল্লেখ্য, একবার ১৯৫৪ সালে, এরপর ১৯৫৭ সালে শহীদ মিনারটি প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সেটি ভেঙ্গে ফেলা হলে ১৯৭২ সালে পুনরায় শহীদ মিনারটি বর্তমান অবয়বে স্থাপিত হয়। ] ১৯৫২ সালে অনুষ্ঠিত ‘সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্মেলন’ এর দাবিগুলোর মধ্যে ছিল- বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা, রাজবন্দিদের মুক্তি এবং পূর্ববাংলার স্বায়ত্বশাসন। এসব দাবি আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত রইল। উল্লেখ্য, ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংষদ’ এবং ‘সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্মেলন’ এর সদস্যদের অনেকেই ছিলেন বামদলগুলোর সাথে যুক্ত। সেসময় জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভাষা রক্ষার আন্দোলন-সংগ্রাম ধাপে ধাপে এগিয়ে রাজধানী পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। আ. গাফফার চৌধুরীর লিখা ও আলতাফ মাহমুদ কর্তৃক সুর করা-“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি?” গানটি ভাষা আন্দোলনের মাত্রাকে যে কি পর্যায়ে নিয়ে গেছিল সেটি বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। গর্বের সাথে বলা যায়, বাহান্নর ভাষা আন্দোলনই হলো স্বাধীনতা আন্দোরনের প্রথম সোপান। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি এলেই এদেশের ছাত্র-জনতা মাতৃভাষা বাংলা রক্ষার জন্য নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ও আন্দোলন-সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হতে থাকলো। স্মর্তব্য,ভাষা আন্দোলনের বছরেই ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম। প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হলেন রাজশাহীর মোহাম্মদ সুলতান এবং সাধারণ সম্পাদক ঢাকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। যিনি ১৯৫২-’৫৩ সালে ঢাকা জেলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃস্থানীয় সদস্য ছিলেন। সে সময় বামদলগুলো নিষিদ্ধ থাকায় সকল রাজনৈতিক কর্মি আত্মগোপণে থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক- অরাজনৈতিক সংগঠনভূক্ত হয়ে এবং ছাত্র সংগঠনে জড়িয়ে থেকে কাজ করতো। উল্লেখ থাকে যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলার অর্জিত সম্পদ লুণ্ঠন ও শোষণ করে পশ্চিম পাকিস্তান বিশেষ করে পশ্চিম পাঞ্জাবকে সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তুলতে থাকলো। পাকিস্তানের রাজধানী প্রথমত করাচি,এরপর রাওয়ালপিণ্ডি,আবার সেখান থেকে ইসলামাবাদে স্থানান্তরিত করে ঐসকল শহরকে তিলোত্তমা নগরী হিসেবে গড়ে তোলা হলো। পশ্চিমা সরকারের শাসন-শোষণের প্রতিবাদে বাঙ্গালি জাতির মধ্যে ইস্পাতদৃঢ় একতার জন্ম নিল। পূর্ব বাংলার ছোট-বড় বেশ ক’টি দল সমন্বয়ে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গঠিত হলো হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্টের মূল দলগুলো-মৌ.আ. হামিদ খান ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী মুসলিম লীগ (আওয়ামী লীগ), এ.কে.ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি, মৌ. আতাহার আলীর নিজামে ইসলাম এবং হাজী মো. দানেশ এবং মাহমুদ আলীর গণতন্ত্রী দল। অতঃপর এলো সেই প্রত্যাশিত ১৯৫৪’র ‘পূর্ব বাংলার আইন পরিষদ’ নির্বাচন। এ নির্বাচনে দ্বিজাতি-তত্ত্ব নির্ভর ও একমাত্র উর্দু রাষ্ট্রভাষা করার দল মুসলিম লীগের ভরাডুবি হলো। সর্বোচ্চ আসন পেয়ে পূর্ব বাংলায় গঠিত হলো যুক্তফ্রন্ট সরকার। যুক্তফ্রন্ট গঠনে এদেশের ছাত্রসমাজ ও বাম দলগুলোর ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মত। এর পর শুরু হলো পশ্চিমা শাসক কর্তৃক ভিন্নতর ষড়যন্ত্র। চুয়ান্নর নির্বাচনের এক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মুহাম্মদ একটি ‘অর্ডিনেন্স’ জারি করে নির্বাচিত এ সরকারকে বাতিল করলেন। পশ্চিমা শাসকদের কি বিচিত্র রাজনৈতিক খেলা! ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবরে এলো ইস্কান্দার মীর্জার সামরিক আইন। অতঃপর মাত্র ২০ দিনের মাথায় মীর্জার পদত্যাগ এবং ২৭ অক্টোবর থেকে শুরু হলো প্রধান সেনাপতি আইয়ুব খানের সামুরিক শাসন। ’৬৬ ’র ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৮ ’র আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন, ’৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, ’৭০ এর সাধারণ নির্বাচন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে এদেশের মানুষ কিছু পাওয়ার পরিবর্তে, তাদের জড়িয়ে পড়তে হলো অস্তিত্বের লড়াইয়ে। ঝড়লো বহু রক্ত, জাতির ভাগ্যে জুটলো শোষণ আর বঞ্চনা। তাই এ জাতি ধীরে ধীরে ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্ব শাসন, শোষণ-বঞ্চনা এবং সামরিক শাসনের যাতাকল থেকে মুক্তি লাভের জন্য ইস্পাতদৃঢ় একতা নিয়ে সংগ্রামী হয়ে উঠলো। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনও এ জাতির একটি সংগ্রামী ফসল। সামরিক শাসনের পালাবদল- আইয়ুব খানের পর এল ইয়াহিয়া খান। সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হলো। ভেবেছিল, বাংগালি জাতি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়বে। শেখ মুজিব তথা আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। কিন্তু বাংগালি জাতি সেদিন ভুল করে নি। সারাদেশে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনলো। এর পরও ষড়যন্ত্রের শেষ হলো না। ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে ক্ষমতা না দিয়ে ভুট্টো সহ অন্যান্য দোসরদের সাথে পরামর্শ করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে বাংলার নিরীহ জনগণের উপর সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করে পালিয়ে গেল পশ্চিম পাকিস্তানে। শুরু হলো মুক্তি যুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস পর বহু রক্ত, সম্ভ্রম, অত্যাচার-নিপীড়নের বদৌলতে এদেশের মানুষ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ ছিনিয়ে আনলো বহু প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা। অসীম ত্যাগ-তীতিক্ষা ও অনেক রক্তের দামে কেনা স্বাধীনতাকে কি এ জাতি কখনো ভূলুণ্ঠিত হতে দিতে পারে? দুখিনী সেই একুশ আজ আমাদের এনে দিয়েছে স্বাধীনতা ও মর্যাদা। মোদের মায়ের ভাষা- বাংলা আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। একুশ মোদের অহঙ্কার। আজ একুশ নয় শুধু বাঙ্গালির একার, একুশ সবার। একুশ আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। লেখক পরিচিতি হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার তীর্থ-ভূমি তেঁতুলিয়া থানার (পঞ্চগড় জেলা) মহানন্দা নদী-তীরে অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম কালারামজোত। এ গ্রামের মধ্যবিত্ত এক মুসলিম পরিবারে জনাব এম, এ, হান্নান ১৯৪৯ খ্রি: ২৬ জানুয়ারি জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোহাম্মদ আলী। মাতার নাম বসিরন নেছা। তিনি পিতা-মাতার চতুর্থ সন্তান। প্রকৃতি প্রেমী দুরন্ত এ ছেলেটি বাল্যকালে পিতাকে হারান। বাল্যকালে পিতৃহারা হয়েও বড় তিন ভাই ও মায়ের ভালবাসা এবং স্নেহ আদরে তিনি বড় হয়ে ওঠেন। মা কোনদিন তাকে পিতার অভাবকে অনুভব করতে না দিলেও অকালে পিতা হারানোর ব্যাথা তাকে যেমনই করেছে স্বাধীনচেতা তেমনই করেছে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও রূঢ়-বাস্তববাদি। তার অদম্য ইচ্ছা, পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ও একাগ্রতা তাকে সামনে এগিয়ে যেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। উল্লেখ্য, তেঁতুলিয়া হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়া কালেই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক বাবু মেঘনাথ দাশ তাকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ক্লাশ নিতে পাঠাতেন। এভাবেই তার শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয় এবং আই,এস-সি পাস করেই একই স্কুলে তিনি শিক্ষকতা পেশা শুরু করেন। তিনি কলেজে পড়া ও শিক্ষকতা পেশায় থাকাকালীণ দেশের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। পড়ালেখার প্রতি অদম্য আকাঙ্ক্ষার কারণে শিক্ষকতা পেশায় অর্জিত ও সঞ্চিত অর্থ দিয়ে ১৯৬৮ সালে তৎকালীণ দিনাজপুর সরকারি কলেজে বি.এস-সিতে ভর্তি হোন এবং বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কলেজে পড়া কালীন তিনি পাকিস্তান ক্যাডেট কর্পস ট্রেনিং গ্রহণ করেন এবং ছাত্র ইউনিয়নে যুক্ত হয়ে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের কামউনিস্ট পার্টির ছত্রছায়ায় থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলে কৃষক সমিতি, ন্যাপ ও ক্ষেতমজুর সমিতির দায়িত্ব পালন করেন। আটষট্রি-উনসত্তোরের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম তথা স্বাধীকার আন্দোলনে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি মুক্তযুদ্ধের সময় গুরুত্বর্পূণ সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন এবং ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত বিশেষ গেরিলা বাহিনীর সক্রিয় সদস্য তথা বীর মুক্তযিোদ্ধা ছিলেন। ছাত্র অবস্থায় তিনি সাংবাদিকতাও করেন এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে তার বহু লেখা প্রকাশিত হয়। প্রথম জীবনে তিনি দীর্ঘ দিন বিভিন্ন হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন বীমা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে বহু মানুষের সাথে মেশার সুযোগ লাভ করেন। চাকরি করা কালে তিনি বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলা সফর করেন। রাজনীতি ও চাকরির সুবাদে তিনি অনেক সনামধন্য ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য লাভ করেন। তাঁর সখ- অবসরে পড়ালেখা করা, খেলাধূলা করা, বিশেষকরে দাবা খেলা, দেশভ্রমণ এবং প্রকৃতিকে গভীরভাবে জানা। আকাশচূম্বি মনোবল, নিখাদ দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি অকৃত্তিম ভালবাসা, নীতি-নৈতিকতা তার চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট। বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন-সংগ্রাম ও নানা ঘাত-প্রতিঘাতে এগিয়ে চলার অভিজ্ঞতার অধিকারী দৃঢ় ও স্বাধীনচেতা এ মানুষটি সম্পর্কে অল্প কথায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বলা যায়, তিনি একজন জ্ঞানপিপাসু, প্রকৃতিপ্রেমি ও আপোষহীন সংগ্রামী মানুষ। -প্রকাশক

0 Shares