Home » সাহিত্য » ঢাকা জিপিও’র সেই প্রিয় মতিন ভাই

ঢাকা জিপিও’র সেই প্রিয় মতিন ভাই

 

 

 

……………………………………………………………………………………………………………………………………
বি এম ইউসুফ আলী: ঈদের দিন। ক্লান্ত বিকেলে বসে আছি। হঠাৎ মৃদু ঝাঁকুনি অনুভব করলাম। না, কোনো ভূমিকম্প নয়। আমার মিসেস কাঁধে হাত দিয়ে হাল্কা ধাক্কা দিয়েছে। আমি তার দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই সে বলল কতবার তোমাকে ডেকেছি অথচ তুমি কোনো সাড়াই দিলে না। ব্যাপার কী? আমি কোনো উত্তর দিলাম না। শুধু বললাম, বল কী হয়েছে? সে বলল, কী চা খাবা? দুধ চা, না রং চা? সে জানে আমি রং চা পছন্দ করি এবং অন্যকে তা খেতে উৎসাহিত করি। সে শুধু দুধ চায়ের মহাভক্ত নয়, তৈরিতে ঝানু, পাকা। তারপরও জিজ্ঞেস করেছে কেন তা বুঝতে আমার বাকি নেই। আমিও একটু মাথা চুলকিয়ে বলি আজ রং চা খেতে ইচ্ছে করছে না। ববং দুধ চা বানাও। আমি জানি এই কথা শোনার পর সে খুশি হবে। ঘটলোও তাই। একগাল হাসি দিয়ে সে কিচেনের দিকে চলে গেল। এই বিষয়টি আমি সবসময় উপভোগ করি। সে অবশ্য এটি জানে কিনা জানি না। কেউ জানুক বা না জানুক আমি তো জানি সে দুধ চা খেতে পছন্দ করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে চা নিয়ে হাজির হল। আমি তার হাত থেকে চায়ের পেয়ালা নিয়ে বড় সড় একটা ধন্যবাদ দিলাম। চায়ে দুই-এক চুমুক দিতেই সে বলল, চা কেমন হয়েছে? আমি বললাম, ভালো হয়েছে। সে এবার বলল, শুধু ভালো হয়েছে? আমার চা তো তোমার কাছে ভালো। তুমি কি কখনো বলেছ যে আমার চা খুব ভালো হয়েছে? বলবে কেন? তুমি তোমার কলেজ ক্যান্টিনে যে পানসে রং চা খাও সেইটা তোমার কাছে মধুর মতো লাগে। হবে না কেন? রিয়াজ স্যার, নজরুল স্যার, সাইফ স্যার, জামান ভাইয়ের সাথে আড্ডা দাও আর চা খাও। চায়ের মজা তুমি কী বুঝবা? মনে মনে বললাম আমি ঠিকই বুঝেছি। এই যখন ভাবছি তখন সে আবারও জিজ্ঞেস করল তুমি তখন কী ভাবছিলে? আমি ফিলোসোফির ছাত্রী। আমি না হয় ভাবতে পারি। তুমি তো পড়েছ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। ওই বিষয়ের স্টুডেন্টদের ভাবার কী আছে? আসলে ১০ মিনিট আগে তার ডাকে সাড়া না দেয়ার জন্যই এতসব। আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে তার কাছে জানতে চাইলাম তুমি তো ভার্সিটিতে হলে থাকতে, তা তোমাদের হলে চিঠি বা মানি অর্ডার কে দিত? বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কথা বললে সে বেশ আনন্দ পায়। কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে যায়। আমিও সেই সুযোগ বরাবর নিয়ে থাকি। উল্লিখিত বিষয়টি তখনই তার মাথা থেকে এক নিমিষেই চলে গেল। যেন খাঁটি সালসা! এবার সে বলল, আমার টাকা তো মানি অর্ডারে আসতো না। আর চিঠি কখনো এসেছে কিনা মনে নেই। কত বছর হল। এতকিছু কী মনে থাকে। তাছাড়া কয়েক যুগ পরে এসে তোমার এসব জানার কী প্রয়োজন? আমি বললাম, না, মানে আজ মতিন ভাই এর কথা বেশ মনে পড়ছে। মতিন ভাই আবার কে? তোমার ইউনিভার্সিটির সব বন্ধুদের আমি মোটামুটি চিনি। কই মতিন নামে কারো কথা তো আগে কখনো শুনি নি। সে বলল।

এখন ডিজিটাল যুগ। বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয়। হাজার কিলোমিটার দূরে কেউ থাকলেও এখন কাছেই মনে হয়। কিন্তু ১০ বছর আগেও আমাদের দেশ ছিল এনালগ। বিশেষ করে আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতাম। তখন যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিঠি। উচ্চবিত্ত বা শহরের মানুষ টিএন্ডটি ফোন ব্যবহার করতো। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলাম। উত্তর পাড়ার একটি হলে থাকতাম। তাই চিঠিই ছিল বাড়ির সাথে যোগাযোগ করার একমাত্র উপায়। তাছাড়া বাড়ি থেকে মাসিক খরচের টাকা ডাক বিভাগের মানি অর্ডারে পাঠানো হতো। আর এই চিঠি বা মানি অর্ডার বিলি করতেন জিপিও এর পিয়ন আব্দুল মতিন। যিনি আমাদের সবার কাছে প্রিয় “মতিন ভাই” হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ভার্সিটি ছেড়েছি ২৫ বছর। কিন্তু কেন জানি এত বছর পরেও মতিন ভাই স্মৃতির আড়ালে চলে যান নি। ডিজিটাল ব্যবস্থার মধ্যেও এনালগ কালের মতিন ভাই মনের গহীন রয়ে গেছেন।

আমি কবি জসিমউদদীন হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। হলে সীটের ব্যবস্থা করেছিলেন যশোরের শ্রদ্ধাভাজন প্রিয় জালাল ভাই । আর দর্শনের খোকন ভাই একদিন সন্ধ্যায় আমাকে পাঁচ তলার ৫৩০ নং কক্ষে তুলে দিয়ে এসেছিলেন। এই রুমে এক সিনিয়র ভাইয়ের সাথে ডাবলিং করতাম। এরপর যথাক্রমে ৫২৫, ৫২৩ এবং ৫২১। ৫২৩ ও ৫২১ ছিল ডাবল সিটের রুম। অন্যগুলো ৪ সিটের হলেও ৫-৮ জন করে থাকত একটি রুমে। যাইহোক, হল জীবনে ডাইনিং রুম, টিভি রুম, রিডিংরুম, গেস্ট রুম, ক্যান্টিনের সাথে যেমন অজানা একটি সম্পর্কের জাল একই সুতোই গাথা থাকত মতিন ভাইয়ের সাথেও তেমন এক নিবিড় সম্পর্ক ছিল। কারণ তিনি ছিলেন ডাকপিয়ন। বাড়ি থেকে পাঠানো টাকাটা তিনি দিয়ে যেতেন। সময় মতো পৌঁছে না দিলে অনেক সময় ঝামেলা হতো। এমনও দিন গেছে হাতে কোনো টাকা পয়সা থাকতো না।

মতিন ভাই হেঁটেহেঁটে সব হলে চিঠি ও মানি অর্ডার বিলি করতেন। কাপড়ের ছোট্ট একটি ব্যাগ আর হাতে ডাইরি জাতীয় একটা কিছু থাকতো। তিনি সবসময় ভাঙতি টাকা দিতেন। মানি অর্ডার ফর্মে স্বাক্ষর করে দিলে তারপর টাকা বুঝে দিতেন। টিপসের আশায় টাকা দিয়ে একটু অপেক্ষা করতেন। টিপস পেলে হাত উঁচিয়ে সালাম দিয়ে বিদায় নিতেন। কম টাকা আসলে অনেক সময় বলতাম মতিন ভাই পরের বার নিয়েন। মনে হত তিনি অখুশি। কিন্তু প্রকাশ করতেন না। আমরাও ধরা দিতাম না।

মতিন ভাই দুপুরের দিকেই বেশি আসতেন। অনেকদিন এমনও হয়েছে তিনি এসেছেন, সেসময় আমি রুমে নেই। রুমে কেউ থাকলে তাকে বলে যেতেন। রুম বন্ধ পেলে সম্ভবত চিরকুট লিখে রেখে যেতেন। যদি বৃহস্পতিবার বা সরকারি বন্ধের আগের দিন হত খবর পেয়ে জিপিওতে চলে যেতাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর মতিন ভাইকে পাওয়া যেত। তার অফিসে মতিন ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে অন্য কলিগরা বুঝতে পারতেন কেন তাকে খুঁজছি।

আমি তখন ৫২৩ নং রুমে থাকি। একদিন দুপুরে তিনি হাজির হলেন আমার রুমে । পাঁচশ টাকা মানি অর্ডার নিয়ে। আমি চিন্তা করছি আমার কাছে তো কেউ টাকা পাঠাইনি। আর টাকা পাঠালে আগেই চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিত। একই সঙ্গে চিঠি ও মানি অর্ডার করত। এই দায়িত্ব পালন করতেন আমার সেজ ভাই। তিনি একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি স্কুলে যাওয়ার পথে চুড়ামনকাটি পোস্ট অফিস থেকে এগুলো পোস্ট করতেন। চিঠি আগেই পৌঁছে যেত। কিন্তু মানি অর্ডার পরে বিলি হত। আমার মনে খটকা লাগলো। তাই আজ ‘বুঝিয়া পাইলাম’ এর স্থানে সই দেয়ার আগে ভালো করে চেক করে দেখলাম। আমার সন্দেহ সত্যি হল। নাম ও রুম নং হুবহু মিল। কিন্তু হলের ক্ষেত্রে গরমিল। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল। সেদিন টাকাটা আমি তুলে নিলে নি:সন্দেহে মতিন ভাই বিপদে পড়তেন। হয়তোবা তাকে গচ্চা দিতে হত। নিন্ম পদে চাকরি করতেন। এখন ভাবি ভুলের কারণে তিনি জীবনে কতোই না বেতন থেকে টাকা দণ্ডি দিয়েছেন। অনেকের সঙ্গে এমন কতই সুখদুখমাখা স্মৃতি জড়িত রয়েছে তার ঠিকঠিকানা নেই।

মতিন ভাইয়ের চেহারা এখনো চোখের সামনে ভাসে। দেখতে শ্যামল বর্ণের। গোলগাল। উচ্চতায় মাঝারি। তিনি কানে কম শুনতেন। বেশির ভাগ দিন তিনি নীল কালারের একটি জামা ও খাকি রংয়ের ফুলপ্যান্ট পরে আসতেন। তবে মাঝে মধ্যে সাদা শার্টও পরতেন। পায়ে চামড়ার সান্ডেল, চোখে চশমা থাকত। মাথায় চুল কম ছিল। আর ব্যবহার করতেন সেই সময়ের জনপ্রিয় ইকনো বলপেন।

১৯৯৬ সালের শেষ দিক পর্যন্ত মতিন ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। শুনেছিলাম তখন তার চাকরি আর কয়েক বছর আছে । জানি না মতিন ভাই কোথায়, কীভাবে আছেন। সেই কথা চিন্তা করতে করতে আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। তাই লুসির ডাক শুনতে পাইনি।

প্রয়োজনে এখনো জিপিওতে যেতে হয়। মতিন ভাই যেখানে বসতেন সেখানে দৃষ্টি চলে যায়। অপলক ভাবে তাকিয়ে থাকি। সেই সিট আছে কিন্তু সেই ছিটে নেই আমাদের প্রিয় মতিন ভাই। বুকের মধ্যে একটা তীব্র কষ্ট অনুভব করি। দ্রুত সরিয়ে নেই আমার সেই দৃষ্টি। আর ভাবতে থাকি ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যিনি সারাজীবন মানুষের খবরাখবর পৌঁছে দিতেন, তার খবর কি আমরা কেউ কখনো রেখেছি?

বি.দ্র. কোনো সহৃদয়বান পাঠক মতিন ভাইয়ের ছবিটি সংগ্রহ করে দিলে খুশি হব।
লেখক পরিচিতি : কলামিস্ট ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। ইমেইল : bmyusuf01@gmail.com

0 Shares