Home » মতামত » দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা:পরিচয়হীনতার ইতিবৃত্ত থেকে আলোকিত এক জনপদ -মো. মামুন অর রশিদ

দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা:পরিচয়হীনতার ইতিবৃত্ত থেকে আলোকিত এক জনপদ -মো. মামুন অর রশিদ

 

 

 

রাষ্ট্র ও পতাকা ছাড়া কখনো কি নাগরিক হিসাবে পরিচয় দেয়া সম্ভব? উত্তর হলো, ‘না’।রাষ্ট্র ও পতাকা না থাকার কারণে যে পরিচয়, তা পরাধীনতা।কয়েক বছর আগেও সিটমহলের মানুষ রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীনতার ইতিবৃত্তে বন্দি ছিলেন। এ রকম পরিচয়হীনতার বৃত্তে আবদ্ধ একটি ছোট্ট জনপদের নাম ছিল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল। রাষ্ট্রহীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা এখন উন্নয়নের ছোঁয়ায় আলোকিত এক জনপদ।

দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তা উপলব্ধি করতে হলে এ সিটমহলের পরাধীনতার ইতিহাস একটু দেখে নেয়া প্রয়োজন। ছিটমহল সমস্যার ইতিহাস অনেক পুরাতন। ১৯৪৭সাল থেকে ১৯৭১সাল পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তান ছিটমহল সমস্যার কোনো সমাধান করেনি। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে ভারত-পাকিস্তান ছিটমহলগুলো বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহলে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী মতী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি’র ১২ ও ১৪ নম্বর সেকশনে ছিটমহল ইস্যুটি সমাধানের কথা বলা হয়।মুজিব-ইন্দিরাচুক্তিতেদক্ষিণবেরুবাড়ীরদক্ষিণঅংশেরবিনিময়েভারতেরতিনবিঘানামকস্থানেদহগ্রাম-আঙ্গরপোতারসঙ্গেভারতের ১৭৮ মিটারদৈর্ঘ্যও ৮৫ মিটারপ্রস্থেরএকটিকরিডরবাংলাদেশকেচিরস্থায়ীভাবেবন্দোবস্তদেওয়ারকথাথাকলেওভারতসরকার ১৯৯২ সালপর্যন্তদীর্ঘ ১৮ বছরবিষয়টিঝুলিয়েরাখে।বাংলাদেশেরপাটগ্রামউপজেলারপানবাড়ীথেকেদহগ্রাম-আঙ্গরপোতারমাঝেমাত্র ১৭৮মিটারদৈর্ঘ্যেরভারতীয়ভূখণ্ডইদহগ্রাম-আঙ্গরপোতাবাসীরবন্দিদশারমূলকারণ। ১৯৪৭সালথেকে ১৯৯২ সালপর্যন্ত ৪৫ বছরধরেদহগ্রাম-আঙ্গরপোতারমানুষকেনিত্যপ্রয়োজনেএই ১৭৮ মিটারদুস্তরপথপাড়িদিতেহয়েছেরাতেরঅন্ধকারে, সীমান্তরক্ষীবাহিনীরগ্রেপ্তার, লাঠিচার্জসহনানাহয়রানিসহ্যকরে।
বাংলাদেশেরঅনবরতদাবিরপরিপ্রেক্ষিতেঅবশেষে ১৯৯২ সালেসেইকরিডরদেওয়াহয়।এরমাধ্যমেদহগ্রাম-আঙ্গরপোতারমানুষখুবসীমিতপরিসরেচলাচলেরসুযোগপায়।বাংলাদেশ ১৯৭১ সালেস্বাধীনহলেওদহগ্রাম-আঙ্গরপোতারমানুষকেশর্তসাপেক্ষেস্বাধীনবাংলাদেশেবৈধভাবেপ্রবেশেরজন্যদীর্ঘ ২১ বছরঅপেক্ষাকরতেহয়েছে।দুইপাশেসশস্ত্রবিএসএফেরসার্বক্ষণিকপাহারায় ১৯৯২ সালের ২৬শেজুনপ্রথমেপ্রতিদুইঘণ্টাপরপরএকঘণ্টাকরেদিনেমোটতিনঘণ্টারজন্যতিনবিঘাকরিডরবাংলাদেশেরনাগরিকদেরযাতায়াতেরজন্যখোলারাখারব্যবস্থাকরাহয়। এরতিনমাসপরসকালছয়টাথেকেসন্ধ্যাছয়টাপর্যন্তপ্রতিএকঘণ্টাপরপরএকঘণ্টাকরেমোটছয়ঘণ্টাখোলারাখারব্যবস্থাকরাহয়এবংএইব্যবস্থাচলতেথাকে ২০০১ সালপর্যন্ত। ২০০১ সালেনতুনব্যবস্থাচালুরমাধ্যমেকরিডরটিসকালছয়টাথেকেসন্ধ্যাছয়টাপর্যন্তনিরবচ্ছিন্নভাবে ১২ ঘণ্টাখোলারাখারব্যবস্থাকরাহয়। বাকি ১২ ঘণ্টারজন্যদহগ্রাম-আঙ্গরপোতারপুরোজনপদটিছিলএকটিকারাগার! অবশেষে ২০১১ সালের ৬ইসেপ্টেম্বরঢাকায়বাংলাদেশেরপ্রধানমন্ত্রী ও ভারতেরপ্রধানমন্ত্রীরমধ্যকারচুক্তিঅনুযায়ীকরিডরটি ২৪ ঘণ্টারজন্যখুলেদেওয়াহয়। ২০১১ সালের ১৯শেঅক্টোবরবাংলাদেশেরপ্রধানমন্ত্রীশেখহাসিনাআনুষ্ঠানিকভাবেকরিডরটি ২৪ ঘণ্টারজন্যউন্মুক্তরাখারঘোষণাদেন।
১৯৪৭ থেকে ১৯৯২ সালপর্যন্তএখানেকতমানুষযেবিনাচিকিৎসায়মারাগিয়েছেতারকোনোহিসাবনেই।মৃত্যুরপরঅনেকেরভাগ্যেদাফনেরকাপড়পর্যন্তজোটেনাই। এখনোদহগ্রাম-আঙ্গরপোতারমানুষপূর্বেরবঞ্চনারকথাস্মৃতিচারণকরলেতাঁদেরচোখদিয়েপানিঝরে।
বর্তমানদহগ্রাম-আঙ্গরপোতায়পুরোদমেউন্নয়নকর্মকাণ্ডবাস্তবায়িতহচ্ছে। ২০১১ সালেরপূর্বেএখানেকোনোহাসপাতালছিলনা। বর্তমানেএখানে২০ শয্যারএকটিহাসপাতাল-সহতিনটিকমিউনিটিক্লিনিকপ্রতিষ্ঠাকরাহয়েছে। কয়েকবছরআগেওএখানেকেউঅসুস্থহলেচিকিৎসারকোনোব্যবস্থাছিলনা। এখনহাতেরকাছেচিকিৎসাসেবাপেয়েএখানকারমানুষআপ্লুত।
শিক্ষাক্ষেত্রেওএগিয়েযাচ্ছেদহগ্রাম-আঙ্গরপোতা। সরকার ২০১৩ সালের ১৬ইঅক্টোবরদহগ্রামউচ্চবিদ্যালয়কেজাতীয়করণকরে।পরবর্তীসময়দহগ্রামসরকারিউচ্চবিদ্যালয়কেকলেজিয়েটকরাহয়।দহগ্রামসরকারিউচ্চবিদ্যালয়েএকটিছয়তলাএকাডেমিকভবননির্মাণকরাহয়েছে। এছাড়াওএখানেরয়েছে৬টি সরকারিপ্রাথমিকবিদ্যালয়এবং ১টি এমপিওভুক্তমাদ্রাসা।যেভূখণ্ডেএকসময়সাক্ষরজ্ঞানঅর্জনকরাওদুরূহছিল,সেখানেশিক্ষার্থীরাস্থানীয়শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেপড়াশোনারসুযোগপাচ্ছে। এখানকারছেলে-মেয়েরাএখনবাংলাদেশসিভিলসার্ভিসসহগুরুত্বপূর্ণবিভিন্নপদেচাকরিকরছেন।
আইন-শৃঙ্খলাপরিস্থিতিস্বাভাবিকরাখারজন্যএখানেএকটিপুলিশফাঁড়িস্থাপনকরাহয়েছে।এইফাঁড়িস্থাপনেরফলেদহগ্রামইউনিয়নেরআইন-শৃঙ্খলাপরিস্থিতিরউন্নতিহয়েছে।আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীরতৎপরতারকারণেএখানকারমানুষশান্তিতেআছেন।
২২.৮ বর্গকিলোমিটারেরএইজনপদেরপ্রায়শতভাগএলাকায়বিদ্যুৎ পৌঁছেগিয়েছে। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতারযোগাযোগব্যবস্থাওউন্নতহয়েছে। এখানকার৪১ কিলোমিটাররাস্তারঅধিকাংশইপাকাহয়েছে। বাকিরাস্তাওপাকাকরণেরকাজচলমান।

আশ্রয়ণপ্রকল্পেরআওতায়দহগ্রামেভূমিহীন ও গৃহহীনমানুষেরজন্যগৃহনির্মাণকরেদেওয়াহয়েছে।এরফলেগৃহহীনমানুষেরমাথাগোঁজারঠাঁইহয়েছে।সামাজিকনিরাপত্তাকর্মসূচিরআওতায়সরকারিনীতিমালাঅনুযায়ীএখানেবয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, প্রতিবন্ধীভাতা, মাতৃত্বকালীনভাতা-সহঅন্যান্যভাতাপ্রদানকরাহচ্ছে। যাদারিদ্র্যদূরীকরণেসহায়কভূমিকাপালনকরছে। যুবউন্নয়নঅধিদপ্তরেরপ্রশিক্ষণগ্রহণকরেদহগ্রামইউনিয়নেরঅনেকেইনিজস্বখামারতৈরিকরেছেন। এখানেমোট ১৭৫টি হাঁস, মুরগি ও গোরুরখামাররয়েছে। এসবখামারস্থানীয়অর্থনীতিতেগুরুত্বপূর্ণভূমিকাপালনকরছে।

দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায়সরকারেরব্যাপকউন্নয়নকর্মকাণ্ডবাস্তবায়নেরফলে এ এলাকারমানুষপ্রকৃতস্বাধীনতারস্বাদপেতেশুরুকরেছে।দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায়সরকারেরএইউন্নয়নকর্মকাণ্ডঅব্যাহতথাকলে এ জনপদেরমানুষেরআর্থ-সামাজিকঅবস্থারআরওউন্নয়নঘটবে।দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায়রয়েছেপর্যটনেরঅপারসম্ভাবনা। এ সম্ভাবনাকেকাজেলাগানোসম্ভবহলেদেশেরঅর্থনীতিতেদহগ্রাম-আঙ্গরপোতাগুরুত্বপূর্ণভূমিকারাখবে।
লেখক :সিনিয়রতথ্যঅফিসার, আঞ্চলিকতথ্যঅফিস, রংপুর

0 Shares