Home » আন্তর্জাতিক » পাল্টাপাল্টি শুল্ক, বিরল খনিজের জন্য প্রতিযোগিতা: এরপরও যেভাবে বৈঠকের জন্য রাজি হলেন ট্রাম্প-শি

পাল্টাপাল্টি শুল্ক, বিরল খনিজের জন্য প্রতিযোগিতা: এরপরও যেভাবে বৈঠকের জন্য রাজি হলেন ট্রাম্প-শি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আজ বৃহস্পতিবার বৈঠকে বসছেন, যেখানে দেশ দুটির একটি বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

উভয় পক্ষের কর্মকর্তারা এই সপ্তাহের শুরুর দিকে জানিয়েছিলেন, তারা ‘স্ব স্ব উদ্বেগ নিরসনে’ একমত হয়েছেন।

মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট এটাও বলেছেন, ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর যে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছিলেন, তা কার্যকর হবে বলে বলেও তিনি মনে করেন না।

তবে এটিই একমাত্র উদ্বেগ নয়। বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতি —প্রতিশোধমূলক পাল্টাপাল্টি শুল্ক থেকে শুরু করে আধুনিক উৎপাদনের ভিত্তি গড়া গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও সেমিকন্ডাক্টরের প্রবেশাধিকার পর্যন্ত প্রায় সবকিছু নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

এমনকি জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে চীনা মালিকানাধীন জনপ্রিয় অ্যাপ টিকটকও দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনার একটি উৎস হয়ে উঠেছে।

পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, মুখোমুখি বৈঠকে ট্রাম্প ও শি যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের কার্যক্রম বিক্রির বিষয়ে চুক্তি চূড়ান্ত করবেন।

দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান শহরের গিমহে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

জায়গাটি খুব একটা পরিচিত না হলেও এই বৈঠকের গুরুত্ব অনেক।

“এটি এমন এক বৈঠক, যা কোভিড-পরবর্তী যুগে বিশ্বায়নকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে,” বলেন অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনির অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক টিম হারকোর্ট।

প্রতিশোধমূলক শুল্ক, টালমাটাল সমঝোতা, আর বিশ্বজুড়ে শিল্প ও ব্যবসার অনিশ্চয়তার দীর্ঘ সময় পাড় করে এই বৈঠকে পৌঁছাতে ১০ মাস লেগেছে।

তো, এই পর্যন্ত আসা গেলো কীভাবে?

প্রতিশোধমূলক শুল্ক—আর এক যুদ্ধবিরতি
গত দোসরা এপ্রিলকে ‘লিবারেশন ডে’ নামে অভিহিত করে বিভিন্ন দেশের ওপর ‘প্রতিশোধমূলত’ শুল্ক ঘোষণা করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মাধ্যমে তিনি মিত্র-প্রতিপক্ষ সব দেশের ওপরই শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন।

তবে এর অনেক আগেই চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছিলেন ট্রাম্প।

‘অন্যায্য বাণিজ্যচর্চার’ অভিযোগ তুলে বহুদিন ধরেই চীনকে নিশানা করছিলেন এবং প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও দেশটির ওপর শুল্কের আঘাত হানেন তিনি।

দ্বিতীয় দফার শুরুতেই, ফেব্রুয়ারির দিকে সব ধরনের চীনা পণ্যের ওপর আরও ১০ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করেন ট্রাম্প।

পাল্টা জবাবে বেইজিং নিজস্ব শুল্ক আরোপ করলে ট্রাম্প পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় চীনা পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করে।

এরপর ‘লিবারেশন ডে’-তে ট্রাম্প চীনকে অতিরিক্ত ৩৪ শতাংশ শুল্কের হুমকি দেন। প্রতিশোধমূলক এই পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা চলতে থাকে, মার্কিন শুল্ক পৌঁছে যায় ১৪৫ শতাংশে আর চীনা শুল্ক ১২৫ শতাংশে।

এসব চমকপ্রদ সংখ্যায় দিশেহারা হয়ে পড়ে প্রস্তুতকারক ও আমদানিকারকরা।

চীনের গুদামগুলোতে পণ্যের স্তূপ জমে যায়, আর উদ্বিগ্ন মার্কিন ব্যবসায়ীরা রাতারাতি বিকল্প সরবরাহ চেইন খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাতে থাকে।

এদিকে, ‘ট্রানশিপমেন্ট’ বা চীনে তৈরি যেসব পণ্য ভিয়েতনামের মতো অন্যান্য দেশের মাধ্যমে ঘুরপথে যুক্তরাষ্ট্রে আসছিল, সেদিকেও নিশানা করে ট্রাম্পের বৈশ্বিক শুল্ক অভিযান।

বেইজিংও পিছু হটেনি। চীন বারবার বলেছে, তারা আলোচনায় আগ্রহী। একইসঙ্গে এটাও স্পষ্ট করেছে যে, প্রয়োজনে ক্ষতি সয়েও তারা নিজেদের অবস্থানে অটল থাকবে।

তারা পাল্টা আঘাত হানতেও সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ, চীন ট্রাম্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাংক কৃষকদের নিশানা করে মার্কিন কৃষিপণ্য- যেমন সয়াবিনের ওপর শুল্ক আরোপ করে।

অ্যাপল থেকে শুরু করে ওয়ালমার্ট পর্যন্ত মার্কিন কোম্পানিগুলোকে চীনা উৎপাদন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ট্রাম্পের প্রচেষ্টাও ব্যাহত হয়েছিল নানা ছাড় ও অব্যাহতির কারণে—আর সেটিই বেইজিংয়ের আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দেয়।

মে মাসে, উভয় পক্ষই এই মর্মে এক নড়বড়ে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায় যে চূড়ান্ত চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত তারা আলোচনা চালিয়ে যাবে।

চিপের লড়াই
শুল্ক নিয়ে আলোচনা চলতে থাকলেও উন্নত চিপ নিয়ে সংঘাতের কারণে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের পুরনো অচলাবস্থা আবার ফিরে আসে। এই চিপ স্মার্টফোন থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই পর্যন্ত প্রায় সবকিছুতেই ব্যবহৃত হয়।

‘বিশ্বের কারখানা’ থেকে নিজেদের অর্থনীতিকে উন্নত প্রযুক্তির কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তরিত করতে চীনের পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে এই চিপ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিপুল মেধা থাকা সত্ত্বেও চীনের সেমিকন্ডাক্টর শিল্প এখনো যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক পিছিয়ে।

এই কারণেই হোয়াইট হাউস উন্নততম চিপে চীনের প্রবেশাধিকার সীমিত রাখার চেষ্টা করছে। ট্রাম্পের আগেই এই পদক্ষেপ শুরু হলেও কেবল তুলনামূলক কম উন্নত সেমিকন্ডাক্টর চীনে রপ্তানির অনুমতি দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিয়ন্ত্রণ আরও কড়া করে।

এই কৌশলের কেন্দ্রে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানি এনভিডিয়া, যার তৈরি চিপগুলো শিল্পজগতে স্বর্ণমান হিসেবে বিবেচিত।

এনভিডিয়ার জন্য চীন বিশাল বাজার। সেখান থেকে কোম্পানিটি বিলিয়ন ডলার আয় করে। ফলে রপ্তানি লাইসেন্সের বিনিময়ে তারা মার্কিন সরকারের কাছে চীনে পণ্য বিক্রির ১৫ শতাংশ রাজস্ব দেয়ার চুক্তিতেও রাজি হয়।

কিন্তু বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রকে অবাক করে দিয়ে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে মার্কিন চিপ না কেনার নির্দেশ দেয়। পরিবর্তে, তারা দেশীয় নির্মাতা যেমন আলিবাবা ও হুয়াওয়েকে ঘিরে শিল্পখাতকে ঐক্যবদ্ধ করে।

একইসঙ্গে, বেইজিং এনভিডিয়ার বিরুদ্ধে অ্যান্টি-মোনোপলি বা একচেটিয়া ব্যবসার তদন্তও শুরু করে।

এই পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে বেইজিংয়ের দীর্ঘদিনের অভিপ্রায় -আরও স্বনির্ভর হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়, বলেন সিঙ্গাপুরের এস রাজরত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের চীন নীতি-বিশ্লেষক স্টেফানি কাম।

তিনি জানান, চীন প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিপুল বিনিয়োগ করছে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্ভাবনে উৎসাহ দিচ্ছে এবং বড় ঝুঁকি নিতে প্রেরণা জোগাচ্ছে।

অর্থনীতির নির্দিষ্ট খাতগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করার এই ক্ষমতাই আংশিকভাবে চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় আরও সহনশীল ও স্থিতিশীল বলে প্রতীয়মান করেছে।

বিশ্লেষকদের ধারণা, চীন দীর্ঘমেয়াদি খেলায় নামছে। অর্থাৎ দেশটি এমন কোনো চুক্তির জন্য তাড়াহুড়ো করছে না যা টিকতেও পারে আবার নাও পারে; বরং তারা পশ্চিমের ওপর কম নির্ভরশীল হতে হয়, এমন শিল্পভিত্তি গড়ে তোলায় বিনিয়োগ করছে।

আরেক লড়াই—বিরল খনিজের জন্য
তবে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নেয়া মানে এই নয় যে, চীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো চুক্তি চায় না।

অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনির অধ্যাপক টিম হারকোর্টের মতে, চীনের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে—বিশেষ করে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট, যেমন বেকারত্ব, দুর্বল ভোক্তা ব্যয়, এবং আবাসন খাতের অস্থিরতা।

তিনি বলেন, “চীনের নেতৃত্ব গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত না হলেও তাদের ওপর মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সমৃদ্ধ রাখা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চাপ রয়েছে”।

“ওয়াশিংটন খুব ভালোভাবেই চীনের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো জানে… চীনের ওপর চাপ থাকায় তারা দীর্ঘমেয়াদে কঠোর কোনো বাণিজ্যযুদ্ধ চায় না”।

তবে শি শক্ত অবস্থান নিয়ে আলোচনায় বসতে চান। সে লক্ষ্যেই অক্টোবরে বিরল খনিজ রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করে পাল্টা আক্রমণে যায় চীন।

এসব গুরুত্বপূর্ণ খনিজের প্রক্রিয়াজাতকরণে চীনের প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য আছে। এগুলো ইলেকট্রনিক্স, সবুজ জ্বালানি প্রযুক্তি এবং সামরিক সরঞ্জামে, যেমন যুদ্ধবিমানে ব্যবহৃত হয়। ফলে এটি ছিল বাণিজ্যযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়।

অস্ট্রেলিয়ার এডিথ কোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নয়স ম্যাকডোনাফের মতে, “মার্কিন প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা চীনের অগ্রগতি ধীর করতে পারে, কিন্তু বিরল খনিজ রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা পুরো শিল্পখাতকেই থামিয়ে দিতে পারে”।

চীনের বিরল খনিজ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের ঘোষণায় স্তম্ভিত হয়ে যায় হোয়াইট হাউস। বিশেষ করে টিকটকের যুক্তরাষ্ট্র শাখা বিক্রির বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা, ট্রাম্পের এমন মন্তব্যের পরপরই ঘোষণাটি আসায় তা আরও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।

এক শীর্ষ মার্কিন বাণিজ্য কর্মকর্তা একে যুক্তরাষ্ট্র-চীন যুদ্ধবিরতির ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে অভিহিত করেন।

এই পদক্ষেপ চীনা সম্পদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতার কথা দেশটিকে তীব্রভাবে মনে করিয়ে দেয়।

এর পরপরই চীনের বাইরে থেকে বিরল খনিজ সরবরাহ নিশ্চিত করতে অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও জাপানের সঙ্গে একের পর এক চুক্তি করে ওয়াশিংটন। অধ্যাপক টিম হারকোর্টের ভাষায়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একধরনের ‘বিমা’ ছিল।

এই চুক্তিগুলোর মধ্যেই ট্রাম্প ও তার আলোচক দল বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নরম করার চেষ্টা শুরু করে এবং বৃহস্পতিবারের বৈঠক আয়োজনের জন্য চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে।

পার্থক্যগুলো বিশাল, প্রতিদ্বন্দ্বিতাও গভীর—তবু “কিছু সহজ সমাধানের পথ আছে,” বলেন অধ্যাপক স্টেফানি কাম। যেমন, চীন যদি বিরল খনিজ রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ কিছুটা বিলম্বিত করে, তার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র কিছু শুল্ক কমাতে পারে।

রয়টার্সের তথ্যমতে, আলোচনার আগের দিনই মৌসুমের প্রথম সয়াবিন চালান কেনে বেইজিং, যা ট্রাম্প ও মার্কিন কৃষকদের জন্য এক বড় সাফল্য। শি আশা করছেন এর বিনিময়ে চীনের ওপর চিপ বিক্রির নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করা হবে।

বিশ্লেষকরা প্রত্যাশা করছেন, টিকটক চুক্তিতে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়াটাও ট্রাম্পের জন্য আরেকটি বড় জয় হতে পারে।

চুক্তিটি যতই ভঙ্গুর হোক না কেন, এটি “আসন্ন মাসগুলোতে অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তের ঝুঁকি কমাতে পারে,” বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক কাম।

এবিষয়ে অধ্যাপক হারকোর্টও একমত, “আমি এখনো মনে করি, ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি বেশ অস্থির… কিন্তু এই আলোচনা কিছুটা হলেও পরিস্থিতি শান্ত করতে পারে”।

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কোনো যুদ্ধবিরতি চিরস্থায়ী হবে না”।

Article Information
Author,ওসমন্ড শিয়া
Role,অর্থনীতি বিষয়ক সংবাদদাতা

0 Shares