Home » মতামত » বেবি ব্লুজ -ডা. সুমাইয়া বিনতে ঋতু

বেবি ব্লুজ -ডা. সুমাইয়া বিনতে ঋতু

মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে রুনা,দুই ভাই আর মা- বাবা নিয়ে তাদের সংসার। বাবা ব্যবসায়ী আর মা গৃহিণী, বড়ো ভাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আর ছোট ভাই সবে এস এস সি পাস করে কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে রুনার বিয়ের প্রস্তাব আসে। রুনা মাত্র অনার্স প্রথম বর্ষ শেষ করে দ্বিতীয় বর্ষে, মা- বাবার কাছে প্রস্তাবটি মনপুত হওয়ায় কম্পিউটার ব্যবসায়ী ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় রুমার। ভালোই কাটছিলো তাদের জীবন। বাবার বাড়ি, শশুর বাড়ি দুই জায়গাতেই থেকে সবকিছু সমন্বয় করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলো রুনা। বছর দেড়েক পরে তার বাচ্চার জন্ম হলো। বাচ্চা জন্মের সময় কিছুটা জটিলতা হয়েছিল। যদিও স্বামী, শশুর- শাশুড়ি, মা-বাবাসহ সবাই সব সময় টেক কেয়ার করেছে। নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক পুরো সময় পার করেছে। সন্তান জন্মের পর রুনা ধিরে ধিরে সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে আরও অসুস্থ হয়ে পড়লো। রাতে ঘুম না হওয়া,হটাৎ হঠাৎ কান্না পাওয়া, সব সময় মন খারাপ থাকা ইত্যাদি রুনার অসুস্থতার কারণ হিসেবে দেখা দিল। রুনার পরিবার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হোল। ডাক্তার রুনার কেইস হিস্ট্রি শুনে প্রাথমিকভাবে এটিকে “বেবি ব্লুজ” হিসেবে চিহ্নিত করেন।তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পূর্বে কয়েকটি টেস্ট করার জন্য পরামর্শ দেন।ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক ঐদিনই টেস্টগুলো করে ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখানো হলো। ডাক্তার এটাকে ‘ বেবি ব্লুজ ‘ নিশ্চিত করলেন। তিনি রুনা এবং তার পরিবারের সদস্যদের অভয় দিয়ে বল্লেন ভয়ের কিছু নেই। এটা নিরাময়যোগ্য অসুখ। নিয়মিত ওষুধ সেবন এবং পরামর্শ মোতাবেক চললে কোন সমস্যা হবে না। এরপর পরিবারের সবাইকে বিষয়টি
বুঝিয়ে বলেন।
আমাদের দেশে এখনো অধিকাংশ বাবা-মা দ্রুতই মেয়েদের বিয়ে দেয় বা দেয়ার চেষ্টা করে। অধিকাংশ পরিবারের মায়েদের গর্ভে সন্তান আসা থেকে শুরু করে সন্তান জন্ম দেয়া এবং এর পরবর্তী একমাস অত্যান্ত কঠিন সময়ের মধ্যে পার করতে হয়। এই পুরো সময় মায়েদের মতামতের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন হলেও দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে এমনিতেই মায়েদের মতামতের গুরুত্ব দেয়া হয় না। আর এ সময়ে মায়েরা আরও বেশি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এসময় পরিবারের সকলের সাহায্য করা দরকার। নতুন মায়েদের জন্য এটা আরও বেশি দরকার। সন্তান জন্ম গ্রহণের কয়েক দিনের মধ্যে নবজাতকের মা বা বাবা অথবা মা বাবা উভয়েরই মনমরা বা খিটখিটে মেজাজ দেখা দিতে পারে। খুব সাধারণ কারণে হঠাৎ করে কান্নাও পেতে পারে। এ লক্ষ্মণ গুলোকে ‘বেবি ব্লুজ’ বলে। নবজাতক সন্তানকে কোলে নেয়ার পর সাধারণত কয়েক দিনের মধ্যেই এ অনুভূতিগুলো এমনিতেই আর দেখা যায় না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা থেকে যায়। সেক্ষেত্রে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অন্যথায় ভয়াবহ মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
পুরুষের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়। সন্তান জন্ম দেয়ার কয়েক দিনের মধ্যে প্রতি দশজন মেয়ের আট জনের মধ্যে এধরণের মানসিক পরিবর্তন দেখা দেয়। এসময়ে মন মরা ও খারাপ লাগা ছাড়াও আরও অনেক রকম অনুভূতি হতে পারে। এরমধ্যে শিশু পুরোপুরি সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকার পরও অহেতুক শিশুর স্বাস্থ্যগত উদ্বেগ পেয়ে বসা। কোনকিছুতে মন না বসা। সবসময় অন্যমনস্ক হয়ে থাকা। মানসিক অবসাদের মধ্যে দিন অতিবাহিত করা। বেবি ব্লুজের একটা অন্যতম কারণ হলো সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর মায়ের মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। এরমধ্যে হরমোনজনিত প্রভাব বেশি কাজ করে। এড্রিনাল নামক গ্রন্হি থেকে গর্ভকালীন অবস্থায় যে পরিমাণ হরমোন নিঃসৃত হতো তা হঠাৎ করে কমে যায়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা এটাই বেবি ব্লুজের প্রাথমিক কারণ। এছাড়াও মায়েদের বুকের দুধ উৎপন্ন হওয়ার সাথে সাথে গর্ভকালীন অবস্থায় যে পরিমাণ হরমোন শরীরের মধ্যে ছিল সেগুলো ধীরে ধীরে বের হয়ে যেতে থাকে। খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেও আসে ব্যপক পরিবর্তন। মায়েদের এসময় শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সাথে মানসিক পরিবর্তন ও হয়ে থাকে। নবজাতকের কারণে মায়েদের মধ্যে এক ধরনের দায়িত্ববোধ জন্মে,সেটাও একটা মানসিক চাপ হিসেবে দেখা দেয়। একজন মা তার শিশু জন্ম দেয়ার পর হাসপাতাল থেকে বাসায় এসে কয়েক দিন নবজাতকের সাথে অতিবাহিত না করার আগে তার মধ্যে যে মানসিক পরিবর্তন গুলো ঘটে তা কখনো কল্পনা করা যায় না। মা হওয়া যে আনন্দের অনুভূতি তা অনেক মা শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে পারেন না,তাদের জন্য এটা মানসিক চাপ হিসেবে দেখা দেয়। এক্ষেত্রে বড়ো একটা সমস্যা হলো একজন মা সন্তান জন্ম দেয়ার পর যে পরিমাণ উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা তার মধ্যে ছিল, সেগুলো কমতে থাকে এবং মা তখন ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়ে। মা তখন দিনে এমনকি রাতেও ভালো ভাবে ঘুমতে পারে না। বাচ্চা যখন ঘুমিয়ে থাকে তখনও মা’র মধ্যে দুশ্চিন্তা কাজ করে,ঘুম আসে না।
বাবাদের মাঝেও সন্তান জন্ম নেয়ার পর নানা রকম দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ কাজ করে। গবেষণায় দেখা গেছে নতুন বাবাদের ক্ষেত্রে শতকরা দশভাগ এই সমস্যায় ভোগেন। এটাকে বলা হয় Male Postpartum Crisis or Daddy Blues.

সমীক্ষায় দেখা গেছে বাবা হওয়ার পর শিশুর প্রথম ৫ বছরে এই সমস্যা শতকরা ৬৮ ভাগ পর্যন্ত বেড়ে যায়।যারা কম বয়সে বাবা হয় তাদের এসমস্যা বেশি হয়ে থাকে। মায়েরা যত তাড়াতাড়ি সন্তানের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন, বাবারা তত তাড়াতাড়ি পারেন না। এছাড়াও সন্তানের ভরণপোষণ যত্ন নেয়া থেকে বড়ো করে তোলা,তার ভবিষ্যতের বিষয়গুলো নতুন বাবা মাদের জন্য সবসময়ই একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয় যা তাদের মানসিক চাপ হিসেবে কাজ করে। এসময় নতুন বাবারা নিজেদেরকে অনেক সময় বাইরের লোক মনে করে। তাছাড়া বেশি কান্নাকাটি করা শিশু, বেশি দায়দায়িত্ব থাকা, স্ত্রীকে ঠিকমতো বুঝতে না পারা এসবই বাবাদের জন্য মানসিক চাপ হিসেবে কাজ করে। এসময় বাবাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, স্ত্রী সন্তান থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা, নেশা করা,অকারণে মন খারাপ হওয়া, ঠিক মতো ঘুম না হওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। এধরণের সমস্যা দীর্ঘ মেয়াদে দেখা দিলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এটা কোন জটিল অসুখ না,সময়মতো চিকিৎসা করলে সহজেই এ ধরনের মানসিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
নবজাতকের জন্মের সাথে সাথে নতুন বাবা মা’র ও জন্ম হয়। নতুন শিশু, নতুন বাবা মা। সন্তান জন্ম দিতে একজন প্রসূতি মাকে প্রচুর শারীরিক ও মানসিক কষ্ট সহ্য করতে হয়। ফলে সন্তান জন্ম দেয়ার পর তার মন স্বাভাবিকের চেয়ে কোমল ও স্পর্শকাতর থাকে। সন্তান জন্ম দেয়ার আনন্দদায়ক অনুভূতি উপভোগ করার জন্য সকল বাবা মাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। এজন্য পরিবারের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। আগামী দিনের ভবিষ্যতকে আমাদের সকলের সহোযোগিতায় গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি নতুন বাবা মাকেও সুস্থ জীবন যাপন করতে হবে।
-পি. ফি.

0 Shares