আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতের রাজধানী দিল্লিতে দূষণ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মঙ্গলবার তিনবার ‘ক্লাউড সিডিং’ করা হয়েছে। এই প্রথম ভারতে দেশীয় পদ্ধতিতে, দেশের প্রকৌশলীরা কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের পরীক্ষা চালালেন। তবে বুধবার রাত পর্যন্তও সেখানে বৃষ্টি হয় নি। দিল্লির পরিবেশ মন্ত্রী এবং যে বিজ্ঞানীরা এই পরীক্ষা চালিয়েছিলেন, তারা স্বীকার করে নিয়েছেন যে তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ক্লাউড সিডিং-এ মেঘের ভেতরে রাসায়নিক ছড়িয়ে দিয়ে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়। বৃষ্টিপাত ঘটানো হলে বাতাসে ভাসমান দূষিত ধূলিকণা মাটির দিকে নেমে আসে, ফলে দূষণও কমে আসে। দিল্লির পরিবেশ মন্ত্রী মনজিন্দর সিং সিরসা জানিয়েছেন যে, কানপুরের আইআইটির বিশেষজ্ঞরা এদিন বিমান থেকে তিনবার ক্লাউড সিডিং করেছেন। দিল্লির সীমান্ত অঞ্চল বুরারি থেকে শুরু করে পূর্ব দিল্লির ময়ূর বিহার পর্যন্ত তিনটি পৃথক এলাকায় ক্লাউড সিডিং করা হয়েছে। যা জানালেন মন্ত্রী দিল্লির পরিবেশ মন্ত্রী মনজিন্দর সিং সিরসা তার এক্স হ্যান্ডেলে জানিয়েছেন, “একটি সেসনা বিমান থেকে এই ক্লাউড সিডিংয়ের প্রক্রিয়া চালিয়েছে আইআইটি কানপুর। মেরঠের দিক থেকে বিমানটি দিল্লির দিকে উড়ে এসে খেকরা, বুরারি, উত্তর করোল বাগ, ময়ূর বিহার, সাদকপুর আর ভোজপুর এলাকায় ক্লাউড সিডিং করেছে।”বিবিসি ক্লাউড সিডিং করতে আটটি ‘ফ্লায়ার্স’ ব্যবহার করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী। তার কথায়, “একেকটি ফ্লায়ারের ওজন দুই থেকে আড়াই কিলোগ্রাম – একেকটি প্রায় দুই থেকে আড়াই মিনিট চলে। এই ফ্লায়ার্স দিয়েই মেঘের ভেতরে রাসায়নিক ছড়ানো হয়। আইআইটি কানপুরের তথ্য অনুযায়ী ১৫ থেকে ২০ শতাংশ জলীয় বাষ্প থাকে। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে পুরো প্রক্রিয়াটি চলেছে।” তিনি এও বলেছিলেন যে যদি এই পরীক্ষা সফল হয়, তাহলে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ক্লাউড সিডিংয়ের পরিকল্পনা নেয়া হবে। তবে বুধবার তিনি নিজেই জানিয়েছেন যে পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে। ওদিকে আইআইটি কানপুরের নির্দেশক মনীন্দ্র আগরওয়াল বিবিসিকে বলেছেন, যদি বৃষ্টিপাতই সাফল্যের মাপকাঠি হয়, তাহলে দিল্লিতে ক্লাউড সিডিংয়ের মাধ্যমে কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আম আদমি পার্টি দিল্লি সরকারের এই পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বর্তমানে ক্ষমতাসীন বিজেপির আগে আম আদমি পার্টিই দীর্ঘদিন দিল্লিতে সরকার চালিয়েছে। দলটির নেতা সৌরভ ভরদ্বাজ জানিয়েছেন, “বিজেপির সরকার আর তাদের মন্ত্রী তো সংবাদ সম্মেলন করে ভগবান ইন্দ্রের কৃতিত্বও নিজেদের বলে দাবি করবেন।” ইন্দ্র বৃষ্টিপাতের দেবতা বলে বিশ্বাস করেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। “এই সরকার ভগবান ইন্দ্রের কাজের জন্যও কৃতিত্ব দাবি করবেন, কারণ বৃষ্টিপাত হলে ঠিকাদারের পাওনা দিতে হবে তো। প্রশ্ন হচ্ছে এমন কোনো যন্ত্র, মন্ত্র-তন্ত্র আছে যা দিয়ে বলা যাবে যে এই বৃষ্টিটা কে ঘটালো,” বলেছেন মি. ভরদ্বাজ। ক্লাউড সিডিং আসলে মেঘের মধ্যে বীজরোপন। সাধারণভাবে বোঝাতে গেলে, মেঘের মধ্যে বৃষ্টির বীজরোপন করাকেই ক্লাউড সিডিং বলা হয়। যে রাসায়নিক দিয়ে মেঘের মধ্যে বৃষ্টির বীজরোপন করা হয়, তাতে সিলভার আয়োডাইড, পটাশিয়াম ক্লোরাইড আর সোডিয়াম ক্লোরাইডের মতো বিভিন্ন রাসায়নিকের মিশ্রণ। বিমান থেকে মেঘের মধ্যে এই রাসায়নিক মিশ্রণ ছড়িয়ে দেয়া হয়। মেঘের মধ্যে থাকা জলীয় কণা জমিয়ে বরফ করে দেয় এই মিশ্রণ, তারপরে সেই বরফই বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে। ক্লাউড সিডিংয়ের ইতিহাস বেশ পুরনো। মার্কিন বিজ্ঞানী ভিনসেন্ট জে শেফার ক্লাউড সিডিংয়ের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। প্রথম পরীক্ষা চালানো হয় ১৯৪০-এর দশকে, আমেরিকায়। আইআইটি কানপুরের অধ্যাপক এসএন ত্রিপাঠি বিবিসিকে বলছিলেন, “যেখানে কোনও মেঘ নেই, সেখানে ক্লাউড সিডিং করা যায় না, তাই প্রথমেই আমরা দেখে নিই যে আকাশে মেঘ আছে, কি না। যদি মেঘ থাকে, তাহলে তা কত উঁচুতে রয়েছে, সেটাও দেখা হয়। বায়ুমণ্ডলের অবস্থাও খতিয়ে দেখা হয়। সেখান থেকে পূর্বাভাস পাওয়া যায় যে মেঘের অভ্যন্তরে জলের পরিমাণ কতটা হতে পারে। “এর পরেই উপযুক্ত জায়গায় মেঘের ভেতরে বিশেষ রাসায়নিক ছড়ানো হয়। জল জমে বরফ করে দেয়া হয়, যা পরে বৃষ্টি হিসেবে নেমে আসে,” বলছিলেন মি. ত্রিপাঠি। অন্য একটি পদ্ধতি আছে, যেখানে মেঘের ভেতরে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। সেভাবেও বৃষ্টিপাত ঘটানো সম্ভব। এই প্রক্রিয়ায় ড্রোন দিয়ে বৈদ্যুতিক শক পাঠানো হয়। প্রথম দেশিয় প্রযুক্তিতে ক্লাউড সিডিং ইসরায়েল নিয়মিতই কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে থাকে, কারণ সেদেশে প্রাকৃতিকভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম। সংযুক্ত আরব আমিরাতেও এ নিয়ে গবেষণা প্রকল্প যেমন চালায়, তেমনই এই পদ্ধতি ব্যবহারও করে থাকে। চীন ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিক্সের সময় বিমান আর ভূমি – দুইভাবেই ক্লাউড সিডিং করে বৃষ্টিপাত করিয়েছিল – যার ফলে পরিবেশ দূষণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছিল। ভারতেও আগে ক্লাউড সিডিং করা হয়েছিল। তামিলনাডুতে ভয়াবহ খরা চলেছিল ১৯৮৪ সালে। তা থেকে মুক্তি পেতে সেখানকার সরকার ১৯৮৪-৮৭, আবার ১৯৯৩-৯৪ সালে দ্বিতীয়বার ক্লাউড সিডিং করায়। কর্ণাটক আর মহারাষ্ট্রেও ২০০৩-৪ সালে ক্লাউড সিডিং করা হয়। কিন্তু প্রতিক্ষেত্রেই বিদেশি বিমান থেকে বিদেশি বিজ্ঞানীরা সেই প্রক্রিয়া চালিয়েছিলেন। কানপুর আইআইটি এই প্রথমবার নিজেরা রাসায়নিক তৈরি করেছে ক্লাউড সিডিংয়ের জন্য। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশও তারাই বানিয়েছে।
Newturn24.com Latest News Portal