Home » আন্তর্জাতিক » ভারতে ভোটের ঠিক আগে গ্রেফতার অরবিন্দ কেজরিওয়াল

ভারতে ভোটের ঠিক আগে গ্রেফতার অরবিন্দ কেজরিওয়াল

 

ভারতের রাজধানী দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেফতার করেছে কেন্দ্রীয় তদন্ত এজেন্সি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট।

দিল্লিতে মদের দোকানের লাইসেন্স দেয়ার নীতি বদল করে কেজরিওয়াল এবং কয়েকজন মন্ত্রী ও নেতা মদ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন, এই অভিযোগেরই তদন্ত করছে কেন্দ্রীয় এজেন্সিটি।

এই মামলাতেই কেজরিওয়ালের দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা ও দিল্লির প্রাক্তন উপ-মুখ্যমন্ত্রী মণীষ শিশোদিয়া এক বছরের বেশি সময় ধরে জেলে আছেন।

দলের সংসদ সদস্য সঞ্জয় সিং ওই একই মামলায় গত বছর অক্টোবর মাসে গ্রেফতার হয়েছেন।

অতি সম্প্রতি তেলেঙ্গানার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের মেয়ে কে কভিতাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। বেশ কয়েকজন মদ ব্যবসায়ী, নেতা, মন্ত্রী ও তাদের কয়েকজন আপ্ত সহায়কও জেলে রয়েছেন।

দিল্লির আবগারি নীতি সংক্রান্ত ওই মামলায় কেজরিওয়ালকে জেরা করার জন্য নয়বার সমন পাঠিয়েছিল কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের তদন্ত এজেন্সি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি।
বিবিসি বাংলায় আরও পড়তে পারেন

 

 

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কোনওবারই জেরার মুখোমুখি হননি। তবে আরেক কেন্দ্রীয় এজেন্সি সিবিআই তাকে একবার জেরা করেছিল।
কেজরিওয়ালই ‘মূল চক্রান্তকারী’?

ইডি একটি প্রেস রিলিজ দিয়ে জানিয়েছে যে অরবিন্দ কেজরিওয়ালই এই মামলায় ‘মূল ষড়যন্ত্রকারী’।

দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য তেলেঙ্গানার ক্ষমতাসীন দল ভারত রাষ্ট্র সমিতির নেত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের মেয়ে কে কভিতা কেজরিওয়াল এবং আপ নেতা মণীষ শিশোদিয়া ও সঞ্জয় সিংয়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছিলেন বলে ইডি জানিয়েছে।

কথিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এমন একটি নীতি তৈরি করা হয়েছিল যা দক্ষিণ ভারতের একটি মদ লবিকে উপকৃত করেছিল, যাকে ইডি “সাউথ লবি’ বলে অভিহিত করেছে।

সুবিধার বিনিময়ে ‘সাউথ লবি’ আম আদমি পার্টিকে ১০০ কোটি টাকা দেবে বলে জানিয়েছে ইডি।

কয়েকজন অভিযুক্ত ও সাক্ষীর বয়ানে কেজরিওয়ালের নাম উঠে এসেছিল বলে ইডি তাদের প্রেস বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে।

কী ছিল দিল্লির নতুন আবগারি নীতিতে?

অরবিন্দ কেজরিওয়াল সরকার জাতীয় রাজধানীতে একটি নতুন আবগারি নীতি চালু করে ২০২১ সালের নভেম্বরে।

ওই নীতি অনুযায়ী, সরকার মদ বিক্রয় থেকে সরে আসে এবং বেসরকারি লাইসেন্সধারীদের মদের দোকান চালানোর অনুমতি দেয়।

সরকার জানিয়েছিল কালোবাজারি রুখতে, সরকারের রাজস্ব বাড়াতে এবং সামগ্রিকভাবে গ্রাহকদের সুবিধা দিতেই ওই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

ওই নীতি অনুযায়ী, মধ্যরাত পর্যন্ত মদের দোকান খোলা রাখা যাবে এবং দোকানে অনেক রকম ডিসকাউন্ট দেয়া যেত।

নতুন নীতিতে মদের বিক্রি হঠাৎই আকাশ ছুঁয়েছিল আর দিল্লি সরকারের রাজস্ব বেড়েছিল ২৭ শতাংশ।

তবে বিজেপি ওই নতুন আবগারি নীতির বিরোধিতা করে অভিযোগ করে যে আবাসিক এলাকায় মদের দোকান খোলার অনুমতি দিয়েছে আপ সরকার এবং রাজধানীতে ‘মদের সংস্কৃতি’ প্রচার করছে।

দিল্লির মুখ্য সচিব নরেশ কুমার ২০২২ সালের জুলাই মাসে নতুন আবগারি নীতিতে একটি গুরুতর অনিয়মের বিষয় চিহ্নিত করেন। তার রিপোর্টে মদের লাইসেন্সধারীদের ‘অন্যায্য সুবিধা’ দেয়ার অভিযোগ তোলা হয়।

কোভিড মহামারি চলাকালীন মদের লাইসেন্স ফি বাবদ ১৪৪ কোটি টাকা ছাড়ের কথাও তুলে ধরেন ওই কর্মকর্তা।

মুখ্য সচিবের রিপোর্টের ভিত্তিতে এই ঘটনায় সিবিআই তদন্তের সুপারিশ করেন দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর ভি কে সাক্সেনা।

এরপরেই আপ নেতৃত্বাধীন সরকারের উপর বিজেপি তীব্র রাজনৈতিক আক্রমণ করতে থাকে। দিল্লির ক্ষমতাসীন দলের তরফে ওই অভিযোগ উড়িয়ে দেয়া হয়।

তবে বিতর্ক ওঠার পরেই নতুন আবগারি নীতি প্রত্যাহার করে নেয় দিল্লি সরকার।

তার ফলে নতুন চালু হওয়া ৪০০টিরও বেশি দোকান বন্ধ হয়ে যায়। নতুন নীতি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত মদ বিক্রি আবার সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

অন্তর্বর্তী সুবিধা নয়: আদালতের নির্দেশ

বারবার সমন পাঠিয়ে তাকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা করছে ইডি, এই অভিযোগ তুলে অন্তর্বর্তী সুবিধা পেতে দিল্লি হাইকোর্টে দরবার করেছিলেন কেজরিওয়াল।

বৃহস্পতিবারই সেই আবেদন খারিজ করে দেয় কোর্ট।

তারপর রাতেই সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে ইডির অফিসারেরা পৌঁছন মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি আবাসে।

বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয় তার বাড়ির সামনে। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হলেও দিল্লির পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহর দপ্তর।

ইডি কর্মকর্তাদের আগমন ও মুখ্যমন্ত্রী আবাসের সামনে বিশাল বাহিনী মোতায়েন দেখেই কেজরিওয়ালের দল আম আদমি পার্টির নেতা-নেত্রীরা সন্দেহ করেছিলেন যে সম্ভবত তাদের দলনেতাকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা নিয়েই এসেছে ইডি।

বৃহস্পতিবার রাত নয়টার দিকে মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি আবাসে পৌঁছন ইডি কর্মকর্তারা আর রাত প্রায় এগারোটায় কেজরিওয়ালকে নিয়ে তারা সেখান থেকে বেরোন।

এরপরে দিল্লির রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে কেজরিওয়ালকে ইডির সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

আর শুক্রবার তাকে আদালতে তোলা হবে।

প্রথম মুখ্যমন্ত্রী যিনি গ্রেফতার হলেন

অরবিন্দ কেজরিওয়ালই ভারতের প্রথম পদে আসীন থাকা মুখ্যমন্ত্রী, যিনি গ্রেফতার হলেন।

এর আগে অবিভক্ত বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব পশু খাদ্য কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন, কিন্তু তার একদিন আগেই নিজে পদত্যাগ করে স্ত্রী রাবড়ি দেবীকে মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসিয়ে গিয়েছিলেন।

অতি সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনও গ্রেফতার হয়েছেন কেন্দ্রীয় এজেন্সির হাতে। কিন্তু গ্রেফতার হওয়ার সামান্য কিছুক্ষণ আগে রাজ্যপালের হাতে পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি।

এখন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী গ্রেফতার হওয়ার পরেও তার দল আপ বলছে যে অরবিন্দ কেজরিওয়াল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।

দলের নেত্রী ও মন্ত্রী আতিশী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “অরবিন্দজী দরকার হলে জেল থেকে সরকার চালাবেন। তিনি আগেও মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, এখনও আছেন ,ভবিষ্যতেও থাকবেন।“

প্রচুর দলীয় সমর্থক হাজির হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী আবাসের সামনে।

আম আদমি পার্টি বা আপ-এর নেত্রী আতিশি সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন যে দলীয় আইনজীবীরা চেষ্টা করছেন সুপ্রিম কোর্টে রাতেই আবেদন করতে, যাতে রাত্রিবেলাতেই জরুরি শুনানি করে কেজরিওয়ালের গ্রেফতারি খারিজ করানো যায়।

আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের বাড়িতেও গিয়েছিলেন।

তবে রাতেই শুনানি হতে পারে এমন খবর বৃহস্পতিবার মাঝরাত পর্যন্তও পাওয়া যায় নি।

জাতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলি জানাচ্ছে সম্ভবত বিষয়টি নিয়ে শুক্রবার দিনের বেলাতেই শুনানি হবে।

কংগ্রেস সহ ভারতের প্রায় সব-অ-বিজেপি দলই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেফতারির বিরুদ্ধে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

তাদের মূল বক্তব্য লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে একজন বিরোধী দলীয় মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করা আসলে বিজেপির এক রাজনৈতিক চক্রান্ত।

আবগারি নীতি সংক্রান্ত আর্থিক তছরুপের মামলায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে বিজেপি।

দিল্লি বিজেপির সভাপতি বীরেন্দ্র সচদেভ সাংবাদিকদের বলেন, “আজ দিল্লির প্রতিটি নাগরিক সন্তুষ্ট যে দুর্নীতির অভিযোগে মুখ্যমন্ত্রীকে অবশেষে গ্রেফতার করা হয়েছে।“

তিনি আরও বলেন, “অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেফতারি মানে দুর্নীতির পরাজয়। তার অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত।“

0 Shares