Home » Uncategorized » মোহমেঘ – মাসুমা বকুল

মোহমেঘ – মাসুমা বকুল

কুরিয়ারে একটা প্যাকেট এসেছে বিনুর নামে।
একটু আগে ডেলিভারী ম্যান এসে দিয়ে গেলো। প্যাকেটে কি আছে জানে না বিনু। ওর কোন প্যাকেট আসার কথা ছিলো না। প্রেরকের নাম, ঠিকানা, কন্টাক্ট নাম্বার সবই অচেনা। অচেনা নাম্বারটিতে কল দিলো ও। একবার- দুইবার-তিনবার। বেজেই যাচ্ছে—। ধরলো না কেউ। অনেকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে রইলো বিনু। কিন্তু খুলল না। আলগোছে তুলে রাখলো বুক সেলফের উপর।
ওর মন-মেজাজ এমনিতেই খুব খারাপ যাচ্ছে। শিহাবের সাথে বিশ্রী একটা ঝগড়া করে কথা বন্ধ দুজনের। তার উপর আবার এই নতুন উপদ্রব!
বাইশ বছরের সংসার ওদের। এই বাইশ বছরে অসংখ্য মনোমালিন্যের মূল কারণ হচ্ছে শিহাব। সাধারণ সাংসারিক কথাবার্তার মাঝেই ও হঠাৎ হঠাৎ মেজাজ হারিয়ে ফেলে। সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয় বিনুর সাথে। প্রথম প্রথম বিনু কিছুই বুঝতে পারতো না। সামান্য তুচ্ছ বিষয়ে শিহাব কেন এতো ধমকাচ্ছে ওকে? কেন এতো রাগ দেখাচ্ছে? এখন বিনু বুঝতে পারে, চাকরিজীবী বউকে বাগে রাখার এটা একটা কৌশল ওর। বিনু চাকরি করে নামমাত্র। সবকিছুর জোরদার মালিক হচ্ছে শিহাব। শুধু মাসের প্রথম সপ্তাহে চেকের পাতাটা বিনুর কাছে আসে সিগনেচার দেয়ার জন্য। প্রতিদিন হাত পেতে পথ ভাড়া নিতে হয় শিহাবের কাছ থেকে। বিনু একদিন মুখ ফুটে বলেছি্ল,
-ভাড়ার টাকাটা আমাকে মাসকাবারি দিয়ে দাও না। প্রতিদিন ভাড়া চাইতে মনেও থাকে না। হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে যেতে হয়। গতকাল শিরিনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি।
শিহাব কিছুটা বিরক্ত হলো বিনুর কথায়।
-তুমি ভুলে যাও, সেটা কি আমার দোষ? রাতেই তো নিয়ে রাখতে পার।
-আমি তো তোমার দোষের কথা বলছি না। কিন্তু একসাথে দিয়ে দিলে প্রব্লেমটা কোথায়?
-প্রব্লেম আছে। হাতে টাকা বেশি থাকলে তোমার এটা সেটা কিনতে ইচ্ছে করবে। মাসের মাঝখানে এসে হাত খালি হয়ে যাবে। আমার হাতে অতিরিক্ত টাকা নেই যে, তোমাকে দিতে পারবো।
-তুমি কীভাবে বুঝলে যে, আমি সব টাকা খরচ করে ফেলবো? তুমি কি কখনও আমাকে দিয়ে দেখেছো?
-মহিলাদের স্বভাবই হচ্ছে উল্টাপাল্টা খরচ করা। এখানে বুঝাবুঝির কিছু নেই। আমি কি তোমাকে প্রতিদিন টাকা দিচ্ছি না? তোমার যখন যা প্রয়োজন এনে দিচ্ছি না? তাহলে এটা নিয়ে এতো কথা বলছো কেন? যা করছি তোমাদের ভালোর জন্যই তো করছি। শিহাবের মেজাজ চড়তে শুরু করেছে।
বিনু চোখের জল লুকোতে তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। নিজের উপার্জনের টাকা! সেটা খরচ করার স্বাধীনতাটুকুও তার নেই! নিজের যোগ্যতায় চাকরিটা পেয়েছে। কারো দয়া কিংবা ঘুষের টাকায় নয়। অথচ মালিক বনে বসে আছে তার স্বামী। কি অদ্ভুত নারী জীবন!
কত শত তিক্ত সব স্মৃতিতে ভরে আছে বাইশ বছরের এই যুগল জীবন! ভালোবাসা কি নেই! আছে হয়তো। কিন্তু তিক্ততার আড়ালে ভালোবাসা ঢাকা পড়ে যায় বারবার।
সামান্য একটা বিষয় নিয়ে কি তুলকালাম কাণ্ডটাই না সেদিন করলো শিহাব।
কথায় কথায় বিনু শুধু বলেছিল ‘সঞ্চয়পত্রের পুরো টাকাটা যে তুলে ফেললে, হঠাৎ কোন জরুরি প্রয়োজন হলে উপায় তো আর কিছু থাকলো না। আর তো কোন টাকা নেই। ভেবেছিলাম মেয়েটার জন্য কিছু গয়না গড়তে দেব। সেটাও তো হলো না।’
এ কথায় দপ করে জ্বলে উঠল শিহাব। উচ্চগ্রামে গলা চড়লো ওর।
‘তোমার অ্যাক্সপেক্টেশান দিন দিন আকাশছোঁয়া হয়ে যাচ্ছে, বিনু। চাহিদা বাড়ছে চড়চড় করে। ভাবনার সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই। এতো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ভালো নয়।’
মেশিনে সেলাই করছিল বিনু। হাত-পা দুটোই থেমে গেল একসাথে। কয়েক পল তাকিয়ে র’লো শিহাবের দিকে। চিকচিক করে উঠলো চোখের কোণ। ভীষণ শক্তিতে আটকে দিল সেটাকে। গড়াতে দিল না আর। মনে মনে নিজেকে একটু প্রস্তুত করে নিল। তারপর কঠিন নিষ্কম্প কণ্ঠে বলল,
-কি বললে তুমি? আমি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ? আমার কথার মধ্যে কি উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখলে তুমি? মেয়ের জন্য গয়না গড়ার কথা বলেছি, এতে আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষার কি সিগন্যাল পেলে তুমি? ছোট-বড় কোন কথাই তোমাকে বলা যায় না। সাথে সাথে তোমার রিঅ্যাকশন শুরু হয়ে যায়। উল্টাপাল্টা বকতে থাক। মেয়ের বিয়েতে কি তোমাকে গয়না দিতে হবে না? না দিয়ে থাকতে পারবে?
বিনুর মাথা দিয়ে যেন আগুনের হলকা বেরোচ্ছে। কাঁপছে একটু একটু। এতোটা উত্তেজিত হয়ে পড়বে নিজেই বুঝতে পারেনি।
শিহাব কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল বিনুর দিকে। ও থামতেই স্বমূর্তি ধারণ করলো।
-খুব তো কথা বলতে শিখেছো আজকাল। কথায় কথায় পালটা যুক্তি দিচ্ছ। মেয়ের বিয়ে কি এখনই দিচ্ছ তুমি? এ কথাগুলো এখনই বলতে হবে তোমাকে?
-তবে আর কবে বলবো? দিন দিন হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে সোনার দাম। ভাবনাটা তো এখনই ভাবতে হবে। তুমি যদি ভাবতে, তাহলে আমার তো বলার আর কোন দরকারই ছিলো না। সরকারি চাকরি করছো বলে কি দু’হাতে সব উড়িয়ে দেবে? বাচ্চাদের কথা ভাববে না।
-আমার ভাবনা আমার কাছে আছে। তোমার যখন এতো শখ, তখন তুমি ভাব বসে বসে। যত্তোসব ফালতু প্যাঁচাল। হাতের মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলে দুপদাপ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল শিহাব।
মানুষ চেনা সত্যিই ভীষণ কঠিন। কি শিহাব কি হয়ে গেল!
কেমন দিশেহারার মতো লাগছে বিনুর। ঘরে থাকাটাই তার কাছে অসহ্য লাগছে এখন। চিরদিনের এই অবুঝ আর গোঁয়ার মানুষটি কোনদিনই বুঝবে না তাকে। অসম্মান আর অপমানে চোখ দুটো জ্বালা করছে ওর। বিষয়বুদ্ধি তো নেই-ই লোকটার। উল্টো কারো পরামর্শও কানে তোলে না। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। এদের জন্য একটা সঞ্চিত ফান্ড থাকা দরকার, এটা শিহাবের অজাগতিক মস্তিষ্কে কাজ করে না। আর এসব নিয়ে বিনুর মনোজ্বালাও কম নয়!
ভালো লাগছে না। কিছুই ভালো লাগছে না ওর। ‘বাইরে থেকে ঘুরে আসি একটু’-ভাবতে ভাবতে বুকসেলফের উপর থেকে ঘরের চাবিটা নিতে গিয়ে প্যাকেটটা চোখে পড়ল আবার। ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া চিন্তাস্রোতকে একটু অন্যদিকে ফেরাতে নামিয়ে আনল সেটা। খুলে ফেললো ফড়ফড় করে।
স্বচ্ছ পলিথিন মোড়ানো সমুদ্রনীল একটা বেনারসী শাড়ির অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে ভেতর থেকে। শাড়িটা বের করে আনতেই দেখা গেল, সিল্কের জমিনে ঘন নীল রঙের ভারী সুতোর বুননে একজোড়া ময়ূরী পুরো আঁচলে পেখম ছড়িয়ে আছে। সোনালি জরিসুতোয় বোনা চওড়া পাড়ের শাড়িটি ওকে কেমন বিহবল করে দিল। ভীষণ দাম এবং অদ্ভুত সুন্দর! স্বপ্ন নাকি সত্যি! কিন্তু কে পাঠালো!
পুরো শাড়িটা ভালো করে মেলে ধরলও। হাতড়াতে লাগলো প্যাকেটটা। ওর মন বলছিলো, কিছু একটা আছে। আছেই। হুম! হাতে ঠেকলো কিছু। রুদ্ধশ্বাসে বের করে আনলো সেটা। ছোট্ট একটা চিরকুট। বিনু স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো মেলে ধরলো দু’চোখের সামনে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা-
‘শুভ জন্মদিন’! শুধু এই দিনটাতে পরো। আর কোনদিন জ্বালাবো না।
‘ফেরারী শত্রু’
বিনু নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে। অসাড় চেতনা। বোধহীন। এও কি সম্ভব! বিনু তো কবেই ভুলে গেছে এই শত্রুটাকে। ওর অস্তিত্বে, অনস্তিত্বে কোথাও তো নেই রিন্টু! তাহলে? বিনু তার ভালোবাসার, অবহেলার, মায়ার, তিক্ততার সংসার নিয়ে তো ভালোই ছিল। ভালোই আছে। কোন্ অকূল গহন থেকে ভেসে এলো ও?
বিনুর দু’চোখের পাতায় ঝাঁপিয়ে পড়লো অজস্র স্মৃতি। মন অলিন্দের খাঁজ-খোঁজ থেকে তারা সব হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো আগল ভেঙে। চোখ বুজে স্মৃতিগুলোকে একটু সাজিয়ে নিল মনে মনে।
ডেনিমের রঙ উঠা প্যান্ট, শালিকরঙা প্লেড শার্ট আর বাম হাতে ব্রোঞ্জের মোটা ব্রেসলেট। কাউবয়দের মতো কিনারায় ঢেউ খেলানো বেশ বড়সড় হ্যাটের নিচে চাপা পড়ে আছে ঈষৎ লালচে চুল। দু’ঠোঁটের ফাঁকে ফাইভ ফিফটি ফাইভ জ্বলন্ত সিগারেটসমেত ছেলেটি বিনুর পথ আগলে দাঁড়ালো। পাশেই রাখা তার টকটকে লাল বাজাজ। কয়েকমাস পর পরই বাইকের ব্র্যান্ড চেঞ্জ করে বড়লোক বাপের এই বখে যাওয়া ছেলে। বিনু চিরদিনই একটু ভীতু প্রকৃতির। অপরিচিত কারো সাথে কথা বলতে গেলেই ওর জিভ আড়ষ্ট হয়ে যায়। দ্রিমদ্রিম ঢাক বাজতে থাকে বুকের ভেতর।
খর চৈত্রের এই মধ্য দুপুরে অনেকটা গুণ্ডা সদৃশ এই ছেলেটি তার পথ আটকালো কেন? আশেপাশে তাকাল বিনু। অনেকটাই দূরে চলে গেছে বন্ধুরা। কলেজ ছুটি হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। বই কিনবে বলে ঢুকেছিলো দোকানে। বেরোতেই এই আপদ। বিনু ঘেমে একসা হচ্ছে। লক্ষ্য করেই মুখ খুলল গুণ্ডা কাউবয়,
-চল, তোমাকে ঠাণ্ডা কোক খাওয়াই।
-তোর মাথায় জুতা মারি শয়তান। পথ ছাড়, হারামজাদা। মনে মনে ছেলেটিকে অভিশম্পাত করে চলেছে বিনু। ভাগ্যিস, মনের কথা কেউ শুনতে পায় না! কি যে হতো তাহলে!
ছেলেটি বিনুর দিকে হাত বাড়াতেই ও ছিটকে পিছু হটে গেল।
-পথ ছাড়ুন। আমি বাসায় যাব।
-চল, নামিয়ে দেই তোমাকে।
-আপনার কি মাথা খারাপ!
-হু, পুরাই খারাপ। আর সেটা শুধু তোমার জন্য, সুন্দরী।
বিনুর ভীষণ কান্না পেতে লাগলো। কি করবে ও এখন? ও আল্লাহ কি বিপদে ফেললে আমায়! বুক জুড়ে ধড়াস ধড়াস।
‘ফাহমিদা না? ভরা রোদে কি করছো রাস্তায় দাঁড়িয়ে? বিনুর সমস্ত শরীরে আনন্দের শিহরণ বয়ে গেল।
নাজমুল স্যার! আল্লাহ বড়ই মেহেরবান। বিনু ঘাড় ফেরাল।
স্মিত হাসি নিয়ে বলল, একটা জরুরি বই কেনার ছিল, স্যার। তাই একটু দেরি হয়ে গেল। মোটরসাইকেল ছাড়ার কর্কশ আওয়াজ ওর কানে আজ বড় মোলায়েম শোনালো। চোখের কোণের তেরছা দৃষ্টি দিয়ে দেখলো, হাওয়াই পাল তুলে দ্রুত সটকে যাচ্ছে লালচুলো কাউবয়।
সেই শুরু। তারপর থেকেই এখানে-ওখানে, যখন-তখন ওর পথ আটকে দাঁড়াতো গুণ্ডাটা। বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে। আস্তে আস্তে জেনে গেল সবাই। বাবা ভয় পেয়ে ওর কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। সামনেই বিনুর অনার্স ফাইনাল। উড়ো চিঠি আসতে লাগলো রোজ। পড়ালেখা সব মাথায় উঠলো। বাবা পাত্র খোঁজা শুরু করলেন। মোটামুটি পছন্দসই পাত্র পেলেই বিনুকে বিয়ে দিয়ে দেবেন।
বিনুর এক দূর সম্পর্কের চাচাই শিহাবকে নিয়ে এলেন তার মা-বাবা সমেত। দেখতে ভালো, সরকারি চাকরি করে। ওদের মতোই মধ্যবিত্ত ফ্যমিলি। বিনুর ঠিক এই মুহূর্তে বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না। ভেবেছিল মাস্টার্স শেষ করে চাকরি করবে। কিন্তু এই বজ্জাত ছেলেটি তার সব স্বপ্নের গোড়ায় জল ঢেলে দিল। শিহাবের ফ্যামিলিকে সব জানানো হয়েছিলো।
বিনু বিয়ের পর পড়াশুনা, চাকরি সবই করতে পারবে জেনে কারোরই আর আপত্তি করার কিছু ছিলো না। তাই দু’পক্ষের পারস্পরিক সম্মতিতেই বিয়ের দিন স্থির হয়ে গেলো।
জানালায় দাঁড়িয়ে আনমনে বৃষ্টি দেখছিল বিনু। ভাবছিলো তার অযাচিত বিয়ে নিয়ে। পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ফেরালো এবং জমে গেল সাথে সাথে। তার হাত দু’য়েক দূরে দাঁড়িয়ে আছে রিন্টু। ও এখানে এলো কীভাবে! বাইরে জোর বৃষ্টি। ছেলেটির কাপড়-চোপড় প্রায় ভেজা। বাসায় কেউ নেই। সবাই বিয়ের কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত। মা গেছেন খালার বাসায়। বাইরের গেট তো ভেতর থেকে বন্ধ। নিশ্চয়ই পেছনের বাগান দিয়ে ঢুকেছে বদমাশটা। কিন্তু ওকে আজ কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। বিনু তার প্রায় অসাড় মস্তিস্কে এক সেকেন্ডের লক্ষ ভগ্নাংশে কথাগুলো ভেবে নিল।
ওর কণ্ঠরোধ হয়ে গেছে তীব্র আতংকে। চোখমুখ ফ্যাকাশে। বুঝতে পারল রিন্টু। তবুও নির্মিশেষ তাকিয়ে র’লো বিনুর মুখের দিকে। তারপর হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো ওর পায়ের কাছে।
-বিয়েটা ভেঙে দাও, বিনু। আমি তোমাকে ভালোবাসি। সত্যিই ভালোবাসি। ভেবেছিলাম ভয় দেখিয়ে তোমাকে কাবু করতে পারবো। একটা অ্যাডভেঞ্জার হিসেবে নিয়েছিলাম ভালোবাসাটাকে। বুঝতে পারিনি তুমি আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করবে। এই দেখ, আজ আমি তোমাকে কোন ভয় দেখাতে আসিনি। আমার ভালোবাসার কথা জানাতে এসেছি। প্লিজ, বিনু প্লিজ। কিছু অন্তত বল।
বিনুর চেহারায় রঙ ফিরতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। হারানো সাহসও ফিরে পেয়েছে অনেকটা।
-বিয়েটা ভেঙে দেয়া সম্ভব নয়, রিন্টু ভাই। আমি আপনাকে ভালোবাসি না। ঘৃণা করি।
-আমি জানি সেটা। বাট আই প্রমিজ, বিয়ের পর তুমি আমাকে ভালোবাসবে। ভালোবাসার বিনিময় শুধু ভালোবাসাই হয়। ঘৃণা নয়।
-আপনি অনেক দেরি করে ফেলেছেন। আর আমার মন এতো ঠুনকো নয় যে, সকাল বিকাল সেটা পাত্র বদল হবে। তবে আপনার এই বোধোদয়ের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। এখন আসুন। যে-কোন মুহূর্তে সবাই এসে পড়বে। বিনু কাঠ কাঠ গলায় কথাগুলো বলে বেরিয়ে যাচ্ছিল ঘর ছেড়ে। রিন্টুর কথা শুনে ঘুরে দাঁড়াল ফের।
-আমি তোমার বাবাকে বলবো? ক্ষমা চাইব উনার কাছে? শেষ সুযোগটুকু হাতছাড়া না করার কাতরধ্বনি এখন রিন্টুর কণ্ঠে।
-আমি কি পুতুল? অহেতুক কথা বাড়াবেন না, প্লিজ। ভাগ্যলিপি লেখা হয়ে গেছে আমার। সেখানে কোথাও আপনার নাম নেই।
এরপরও রিন্টু দাঁড়িয়ে র’লো কয়েক মিনিট। তারপর আর কোন কথা না বলে টলতে টলতে বেরিয়ে গেল ভূতে পাওয়া মানুষের মতো।
বিনুও হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে র’লো কিছুক্ষণ। সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো ঘটে গেল! বুকের মধ্যে একটা মন খারাপের হাওয়ার ওড়াওড়ি টের পাচ্ছিল ও। ক্ষণিকের জন্য বুকটা দুলে উঠল কেমন!
বাইরের গেটে করাঘাত কানে আসায় একটা ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে স্থির করলো ও।
এরপর কতো সন্ধ্যা এলো পৃথিবীতে! সূর্য উঠলো, আবার ডুবেও গেল। দু’জন মানুষের মধ্যে ঘটে যাওয়া স্বপ্নসদৃশ ঘটনাটা অতঃপর বিনুও একদিন আস্তে আস্তে বিস্মৃত হয়ে গেল।
আগামীকাল বিনুর পঁয়তাল্লিশতম জন্মদিন।
ও শাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক। মনের মধ্যে অজস্র প্রশ্নের ঝাঁপাঝাঁপি। কোথায় থাকে রিন্টু? বিয়ে করেছে কি? কয় ছেলেমেয়ে ওদের? রিন্টু আজও কেন মনে রেখেছে ওকে? আজও ভালোবাসে। কিন্তু কেন?????
‘শুভ জন্মদিন, মা!’ দু’পাশে দুই ছেলেমেয়ে। পেছনে শিহাব।
-শুনুন, ভদ্রমহিলা। ঝগড়াঝাঁটি যা-ই করি না কেন, আমি কিন্তু আপনাকে খুব ভালোবাসি। শিহাবের হাতে একতোড়া রজনীগন্ধা।
আমরা সবাই তোমাকে খুব ভালোবাসি, মা। ছেলেমেয়ে দুটো কলকল করে উঠলো।
-আরে, বাহ্‌! শাড়িটায় তো তোমাকে দারুণ মানিয়েছে। আগে দেখিনি তো।
-গিফট। ছোট্ট করে উত্তর দিল বিনু।
বুকের ভেতর এক দুঃখনদী বইছে কুলকুল। চোখভরা জল নিয়ে গালভরে হাসলো বিনু।

-১৪.০৪.২০২২, (ছোটগল্প)

0 Shares