Home » মতামত » ডায়রিয়া : প্রয়োজন সচেতনতা -শান্তনু শেখর রায়

ডায়রিয়া : প্রয়োজন সচেতনতা -শান্তনু শেখর রায়

আবহাওয়াজনিত কারণে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধি। এরই মধ্যে ডায়রিয়া, হাম, টাইফয়েড, সর্দি, কাশি, চিকেন পক্সসহ বায়ু ও পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। এ কারণে শিশুরা অত্যন্ত ঝুঁকিতে থাকে। শিশুদের সুস্থ রাখতে বাবা-মাকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কারণ কষ্ট পেলেও শিশুরা তা প্রকাশ করতে পারে না। তাই শিশুর শরীর ঘেমে গেলে সাথে সাথে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে শিশুর ঘাম মুছে দিতে হবে এবং ঠাণ্ডার সময় শিশুকে গরম রাখতে হবে। গরমের সময় তাদের বেশি পরিমাণ তরলজাতীয় খাবার দিতে হবে। গরমে শিশুরা যাতে বাইরে বের হতে না পারে, সেদিকে বাবা-মাকে খেয়াল রাখতে হবে। এ সাথে শীতের সময় গরম কাপড় না পরে শিশু যাতে বাইরে যেতে না পারে, সেদিকেও বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে অভিভাবকদের।

তীব্র গরমে একটু শান্তি পেতে শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ রাস্তায় দূষিত পানি ও শরবত খেয়ে ডায়রিয়া ও পেটের পীড়াসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। আবার তীব্র শীতেও শিশুদের কোল্ড ডায়রিয়া হয় ঠাণ্ডা থেকে। গত বছর মার্চ-এপ্রিল এ দু’মাস গরমের সময় সারাদেশে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে গেছিল। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুম থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। চিকিৎসকদের মতে, মার্চ থেকে গরম শুরু হলেও এপ্রিল মাসের প্রথম থেকে ডায়রিয়া, পেটের পীড়া, আমাশায়, টাইফয়েড, জন্ডিসসহ অন্যান্য রোগের প্রকোপ বেড়ে যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। ডায়রিয়া হলে রোগীকে ওরস্যালাইনসহ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অন্যান্য ওষুধ দিতে হয়। শিশুদের ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ওরস্যালাইন বিতরণ করা হয়।

চিকিৎসকদের মতে, প্রচণ্ড গরমে খেটে খাওয়া মানুষ রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় বিক্রি করা ধুলাবালি মিশ্রিত লেবু ও চিনি মিশ্রিত বরফের শরবত, তরমুজ, আনারস, কাঁচা আমসহ বিভিন্ন ধরণের ফলের শরবত পান করেন। এর মধ্যে ধুলাবালি ছাড়াও অন্যান্য মারাত্মক রোগ-জীবাণু থাকে। এ শরবত খেয়ে অসংখ্য মানুষ পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়। এসব খেলে শিশুরাও আক্রান্ত হয় ভয়াবহ ভাবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে দূষিত পানি ও খাবার থেকে ডায়রিয়া ছাড়াও জন্ডিস, আমাশায়, টাইফয়েডসহ বিভিন্ন ধরনের পানিবাহিত রোগ হতে পারে। এজন্য বিশুদ্ধ পানি খাওয়া একান্ত প্রয়োজন। ডায়রিয়াসহ অন্যান্য নানান রোগ থেকে রক্ষা পেতে বাসি, পচা খাবার খাওয়া যাবে না এবং খাবার আগে ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হবে।

চব্বিশ ঘণটায় তিনবার বা তার বেশি পাতলা পায়খানা ও সাথে বমি হলে, শরীর দুর্বল হলে, খাবারে রুচি কমে গেলে বুঝতে হবে শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। ডায়রিয়ার প্রাথামিক চিকিৎসা হলো খাবার স্যালাইন। শিশু যতবার বমি বা পাতলা পায়খানা করবে, ততবার শিশুকে খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। স্যালাইন খাওয়ানোর ক্ষেত্রে এক প্যাকেট স্যালাইন আধালিটার বিশুদ্ধ পানিতে মেশাতে হবে। স্যালাইনের প্যাকেট ভেঙ্গে একাধিকবার মেশালে হবে না, এতে লবণের মাত্রা কম বেশি হতে পারে এবং লবন ও পানির মাত্রা ব্যাহত হওয়ায় শিশুর সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই এক প্যাকেট স্যালাইন একবারে মিশিয়ে ভালভাবে তা সংরক্ষণ করতে হবে। একবার বানানো খাবার স্যালাইন ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত খাওয়ানো যায়। ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা পরিবার থেকেই শুরু হওয়া আবশ্যক। প্যাকেট স্যালাইন বাসায় না থাকলে ঘরে বসেও খাবার স্যালাইন তৈরি করা যায়। আধা লিটার বিশুদ্ধ পানি, এক মুঠো গুড় এবং এক চিমটি লবণ মিশিয়ে খাবার স্যালাইন তৈরি করা যায়।

শিশুর বয়স এক বছরের মধ্যে হলে স্যালাইনের পাশাপাশি মায়ের বুকের দুধ অবশ্যই দিতে হবে। মায়ের বুকের দুধ ছাড়াও অন্যান্য স্বাভাবিক নরম ও সুসিদ্ধ খাবার দিতে হবে শিশুকে। কাঁচকলা সেদ্ধ করে নরম ভাতের সাথে চটকিয়ে খাওয়ালে ডায়রিয়া কমে যায়। দুই বছরের বেশি বয়সি শিশুদের স্বাভাবিক সব ধরনের খাবার খাওয়াতে হবে। তবে তরল জাতীয় খাবার বেশি করে খাওয়াতে হবে। শিশুকে স্যালাইনের পাশাপাশি ডাবের পানি, চিড়ার পানি, লবণ-গুড়ের শরবত, বিশুদ্ধ খাবার পানি খাওয়াতে হবে। ডায়রিয়ার সবচেয়ে বড় জটিলতা হলো পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন। শিশুর শরীর থেকে প্রয়োজনীয় পানি বের হয়ে যাওয়ার ফলে শিশু দুর্বল হয়ে পড়ে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, চোখ ভেতরে ঢুকে যায়, এমনকি পানি শুন্যতা বেশি হলে তার প্রস্রাবও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় শিশুকে দ্রুত হাসপাতালে না নিলে শিশুর মৃত্যুও হতে পারে।

শিশুকে ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগ থেকে বাঁচাতে জন্মের পর শিশুকে মায়ের বুকের শালদুধ খাওয়াতে হবে। শাল দুধই শিশুর জীবনের প্রথম টিকা বলা হয়। শিশুকে শালদুধ খাওয়ালে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। ফলে শিশু সহজেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় না। ডায়রিয়া যেহেতু পানিবাহিত রোগ, তাই যেসব মায়েরা তাদের শিশুদের ফর্মুলা দুধ খাওয়ান, সেসব ক্ষেত্রে ফিডার ভালো করে পরিষ্কার করে দুধ খাওয়াতে হবে। তা না হলে শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে।

এছাড়া খাবার বা পানি খোলা পাত্রে রাখলে, পানি ফুটিয়ে না খেলে, শিশুর ডায়রিয়া হতে পারে। পানিতে অনেকসময় সহনীয় মাত্রার বেশি রোগ-জীবাণু থাকতে পারে। সেজন্য খাবার পানি ভালোভাবে ফুটিয়ে ঠাণ্ডা
করে পান করা জরুরি। টিউবওয়েলের পানি না ফুটিয়ে খাওয়া যাবে, তবে টিউবওয়েলের পানি আর্সেনিকমুক্ত কি না, তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। খাবার খাওয়ার আগে শিশুর হাত ভাল করে না ধোয়ালে, পায়খানার পর ভালভাবে হাত সাবান দিয়ে না ধুলে শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। তাই শিশুকে সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যেমন- বাইরে থেকে এসে পা ধোয়া, খাবার আগে হাত ভালো করে ধোয়া, নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করা এবং পায়খানার পর হাত সাবান দিয়ে ধোয়ার অভ্যাসগুলো ছোটবেলা থেকেই গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য পরিবারে অভিভাবক এবং পরিবারের সদস্যদের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।

ডায়রিয়া পরবর্তী বেশির ভাগ শিশুই অপুষ্টিতে ভোগে। এ সময় শিশুকে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, পাকা ফলমূল, ফলের রস খেতে দিতে হবে। এতে শিশুর ডায়রিয়াপরবর্তী দুর্বলতা কেটে উঠবে এবং শরীর স্বাভাবিক হবে। দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়া রোগীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তাদের জন্য পৃথক ইউনিট খোলা হয় নিবীড় সেবা প্রদানের জন্য। সেখানে রোগীদের বিশেষভাবে চিকিৎসা দেয়া হয়।

ডায়রিয়া একটি সাধারণ রোগ, কিন্তু সচেতনতার অভাবে এ রোগ মহামারী আকার ধারণ করতে পারে। ডায়রিয়া থেকে রক্ষা পেতে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। বাইরের খাবার বর্জন করতে হবে। খাবার ভালো করে ঢেকে রাখতে হবে এবং বাসি-পচা খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এ বিষয়ে পরিবারের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। কাজেই শিশুসহ সকলের ক্ষেত্রেই ডায়রিয়া প্রতিরোধে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

শান্তনু শেখর রায়, ফ্রিল্যান্স রাইটার।

পিআইডি- শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম (৫ম পর্যায়) প্রকল্প কার্যক্রম।

 

0 Shares