Home » মতামত » দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা -সেলিনা আক্তার

দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা -সেলিনা আক্তার

 

দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। মানব সভ্যতা বিকাশে এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠনে দুর্নীতি প্রধান অন্তরায়। যে সকল দেশে সম্পদের অপ্রতুলতা রয়েছে সেখানে দুর্নীতি রয়েছে।দুর্নীতি এমন এক অপরাধ যা অন্যান্য অপরাধ দমনেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অধিকাংশ  অপরাধের অন্যতম উৎস হচ্ছে দুর্নীতি । বাংলাদেশ, দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির সঙ্গে লড়াই করে আসছে। দুর্নীতি এমন একটি ব্যাধি যা সমাজের মূল কাঠামোকে ক্ষয় করে, অর্থনীতির উন্নয়নে বাধা দেয় এবং জনগণের মধ্যে অসন্তোষ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করে। তবে, সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থা দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যা আশাব্যঞ্জক ফলাফল দেখাচ্ছে।
সাধারণ অর্থে সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি ও মূল্যবোধ পরিপন্থি কাজ করাকে দুর্নীতি বলা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, ঘুস বা অনুগ্রহ দ্বারা কার‌সম্পাদনে ন্যায়পরায়ণতাকে বিকৃত করা বা ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির দ্বারা কোনো কার্য সম্পাদন করাকে দুর্নীতি বলে। মোট কথা আমাদের সমাজের রীতিনীতি মূল্যবোধের প্রেক্ষিতে সুষ্ঠু ও সুন্দর সামাজিক জীবনধারা রক্ষার জন্য যেসব নীতি প্রণীত বা প্রচলিত রয়েছে সেসব রীতিনীতিকে অমান্য বা লঙ্ঘন করা হলো দুর্নীতি।
বাংলাদেশে দুর্নীতি বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়, যেমন: ঘুষ, অনুপ্রবেশ, অর্থ পাচার, নেপোটিজম, এবং অবৈধ লেনদেন। দুর্নীতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্যমোচন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জাতির নৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় । বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, দুর্নীতি কেবল গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে না বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহিত করে। দুর্নীতির সঙ্গে মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। দুর্নীতির কারণে আর্থসামাজিক ক্ষতি হয়। জাতীয় আয়ের ওপর প্রভাব পড়ে, সামাজিক ক্ষতি হয়। দুর্নীতির কারণে মানুষকে জীবনও দিতে হয়- সেই উদাহরণও আছে। প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষুষ্ণতা, সংকট মোকাবিলায় কোনো ধরনের দুর্নীতি সহ্য করা হবে না- এ ধরনের ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও একশ্রেণির অসাধু মানুষ বিভিন্নভাবে দুর্নীতি করছে। এ ক্ষেত্রে তিন ধরনের দুর্নীতি লক্ষ্য করা গেছে। সেগুলো হলো- ক্রয় ও সরবরাহ খাতে দুর্নীতি, সেবা খাতে দুর্নীতি ও ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি। দুর্নীতি দমনে সবাইকে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষুষ্ণতার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ঘোষণাটি প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। যাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব রয়েছে তাদের সৎ হতে হবে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনই পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও এনজিও এবং শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “নেশন মাস্ট বি ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না।” দেশে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করার উদ্দেশে প্রতিষ্ঠা করা হয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও সবসময় দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কথা বলা হচ্ছে। এর জন্য দুদকসহ সব পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ‘শুদ্ধাচার’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেয়া আছে। বাংলাদেশে ২০১২ সালে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণীত হয়েছে। চারিত্রিক সাধুতা বা শুদ্ধতা অর্জন ও দুর্নীতি দমনের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জাতীয় একটি কৌশল দলিল হিসেবে গৃহীত হয়েছে। যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের সুষ্ঠু প্রয়োগ, পদ্ধতিগত সংস্কার ও উন্নয়ন, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সবার চরিত্র নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গৃহীতব্য কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়েছে।

স্বাধীনতার পর থেকেই দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় বহু আইন, বিধি-বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকার বেশ কিছু নতুন আইন প্রণয়ন করেছে, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উন্নয়নে বেশ কিছু নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ, ও প্রতিরোধ করতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গঠন করা হয়েছে। এটি ২০০৪ সালের ৯ মে এর দুর্নীতি দমন আইন অনুসারে কার্যকর হয়েছে। বর্তমান সরকার ২০০৯ সাল থেকে দুদকের ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। ফলে দুদক ক্রমাগত বিকশিত হয়েছে। কমিশনের দক্ষতা ও কার্যকারিতা বাড়াতে বেশকিছু কৌশলগত উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে। এসব উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল কেস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রবর্তন, অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচি প্রসারিত করা। বাংলাদেশে দুর্নীতি মামলায় দ্রুত বিচারের জন্য বিশেষ আদালত স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও, সরকার আইনি প্রক্রিয়াকে আরও সহজ ও গতিশীল করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর সক্রিয়তা। দুদক বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির তদন্ত ও বিচারের জন্য আদালতে মামলা দায়ের কাজ করে থাকে। দুদকের উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্রেতা আছে, বিক্রেতা নেই- এমন ব্যতিক্রমধর্মী ‘সততা স্টোর’ চালু করা হয়েছে। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থা ইউএনওডিসির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ দুদকের কার্যক্রম গ্রহণ করছে। সরকারি চাকরিজীবীদের মঞ্চে দাঁড়িয়ে জবাবদিহিতা ও উত্থাপিত সমস্যা সমাধানে দুদকের বিশেষ কার্যক্রম ‘গণশুনানিও’ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ গ্রহণ করছে। জনগণ ও দুদকের মাঝে সেতুবন্ধ তৈরি করা ‘দুদক হটলাইনও’ আন্যান্য দেশকে আকৃষ্ট করছে। দুদক উদ্ভাবিত অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সততা সংঘ, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, গোয়েন্দা ইউনিট, দুদক এনফোর্সমেন্ট টিম, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট, ফরেনসিক ল্যাব, মোবাইল ট্র্যাকিং সার্ভার, নতুন অর্গানোগ্রাম, সশস্ত্র পুলিশ ইউনিট, হাজতখানা অন্যতম। বর্তমানে দুদকের মামলার সাজার হার ৭৬ শতাংশ, যা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। এর মধ্যে মানি লন্ডারিং মামলার সাজার হার শতভাগ। এছাড়াও, সরকার ই-গভর্নেন্স এর মাধ্যমে সেবার স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করেছে, যা ঘুষ এবং অন্যান্য অনিয়ম হ্রাস করেছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, অভিযোগ নিষ্পত্তিতে রেকর্ড, অনুসন্ধান তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা কাটিয়ে দুদক বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। সংস্থাটি শুধু চুনো পুঁটিদের নিয়ে কাজ করে, রুই-কাতলা ধরে না- এমন অভিযোগ থেকেও বেরিয়ে আসছে। শুধু চুনোপুঁটি নয়, দুদকের মামলায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জেলে আছেন। তদন্ত চলছে একাধিক ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। দুদকের করা মামলার রায়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যেমন সাজা পেয়েছেন, তেমনি দণ্ড হয়েছে বিদেশি নাগরিকদেরও।
বিগত বছরগুলোতে দুর্নীতি দমনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম যেসব আইন প্রণীত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯, তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯, সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৯, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯, চার্টার্ড সেক্রেটারিজ আইন, ২০১০, জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২, প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২ ইত্যাদি। এসব আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে দুর্নীতিমুক্ত রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশ জাতিসংঘের United Nations Convention Against Corruption (UNCAC)-এর অনুসমর্থনকারী দেশ। দুর্নীতি নির্মূলের জন্য ফৌজদারী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ও আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে দুর্নীতির প্রতিকার ছাড়াও দুর্নীতির ঘটনা যেনো না ঘটে এজন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই কনভেনশনে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে শিক্ষা ও সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলো দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার এবং প্রচারণা চালাচ্ছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে আমাদের একতাবদ্ধ হওয়া খুবই জরুরি। এই কঠিন লক্ষ্য সফল করার জন্য মানুষের জীবনের একেবারে গোড়া থেকে, পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। রাজনীতিতেও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে। যদি সমন্বিতভাবে দুর্নীতির কদর্য চেহারাকে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এবং জনস্বার্থে এর কুফল সম্পর্কে তথা জনসচেতনতা সৃষ্টি করা যায়, তাহলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে। দুর্নীতির অভিযানকে সফল করতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ-উদ্যমকে একযোগে কাজে লাগাতে হবে। কেবল আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে দমন করা সম্ভব নয়। এর বিরুদ্ধে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যদিও বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবুও এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে আরও কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগের প্রনিয়োগজন। সরকার, বেসরকারি সংস্থা, মিডিয়া এবং জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে।

দুর্নীতি প্রতিরোধে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা আশাব্যঞ্জক হলেও, এখনও পথ চলা বাকি। সম্মিলিত প্রয়াস, স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কঠোর আইনি প্রক্রিয়া দুর্নীতি প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি। একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে সকলের অংশগ্রহণ এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞা অপরিহার্য।যদি সংঘবদ্ধ ও সমন্বিতভাবে দুর্নীতির কদর্য চেহারাকে পরিচিত করে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এবং জনস্বার্থে এর কুফল সম্পর্কে তথা জনসচেতনতা সৃষ্টি করা যায়, তাহলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে।

-পি. ফি.

0 Shares