Home » মতামত » পঞ্চাশে বাংলাদেশ -পাশা মোস্তফা কামাল

পঞ্চাশে বাংলাদেশ -পাশা মোস্তফা কামাল

এক নদী রক্ত পেরিয়ে তিরিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। দীর্ঘ দুইশ বছর বৃটিশ শাসন আর প্রায় চব্বিশ বছরের পাকিস্তানি শাসন ও শোষণ বর্তমান বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডটির সম্পদ, সংস্কৃতি এবং আভিজাত্যকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ায় বাঙালি জাতি। আপমর মানুষের বুক ভরা ভালোবাসা আর অদম্য সাহস বুকে নিয়ে তিনি বাঙালির বুকে স্বাধীনতার স্বপ্ন একে দেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম আর জাতির পিতার সম্মোহনী নেতৃত্বে বীর বাঙালির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস আমাদের এনে দেয় কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে অনেকে হয়ত ‘কী পেয়েছি’ আর ‘কী পাইনি’ সেই হিসাব কষতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু বস্তুগত হিসাব করার আগে আমাদের ভাবতে হবে আমরা স্বাধীন মানুষ হিসেবে নিজেদের ভাবার অবকাশ পাচ্ছি, সেটাই প্রথম প্রাপ্তি। পকিস্তানের চব্বিশ বছরের শাসনকালে তারা আক্ষরিক অর্থেই আমাদের দাস হিসেবে গণ্য করতো এটা আমাদের বাপদাদারা চোখে দেখেছেন। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল মধ্য যুগের দাস প্রথাকে। প্রতিটি অফিস, আদলত ও কল-কারখানায় পাকিস্তানিরা ছিল প্রভুর ভূমিকায়, আর আমরা ছিলাম তাদের গোলাম। তারা নিজেদের মনে করতো ‘অভিজাত’ আর আমাদের মনে করতো নিম্ন জাতের প্রাণী। এই অভিশাপ থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্তি দেয়ার জন্য সারাটি জীবন সংগ্রাম করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাইতো জাতির পিতা ১৯৭১ সালের ১০ই জানুয়ারি স্বদেশের মাটিতে পা রেখেই দর্পিত উচ্চারণ করেছেন ‘আমার বাঙালি আজ মানুষ’।
দীর্ঘ পরাধীনতার কারণে যে অর্থনৈতিক শোষণের শিকার আমরা হয়েছিলাম সেই কারণেই জন্মের সময় বাংলাদেশ ছিল পৃথিবীর অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত দেশ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমরা তার অনেকটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। কিছু তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে এটা সহজেই চোখে পড়বে। স্বাধীনতার পর মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষই ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে আজ তা ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। এটি নিশ্চয়ই আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে নির্দেশ করে। স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে পরে আমাদের জিডিপি ছিল শুধু ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০২০ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। ১৯৭০ সালে মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১৪০ ডলার, ২০২১ সালে আমাদের মাথাপিছু গড় আয় ২ হাজার ৫৪৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা, আর ২০২০-২১ সালে বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। ১৯৭২-৭৩ সালে উন্নয়ন বাজেটের আকার ছিল ৫০১ কোটি টাকা, ২০২০-২১ সালে হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকা।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণের পেছনে রয়েছে এক কঠিন পথ পাড়ি দেয়ার ইতিহাস। বর্তমান সরকারের রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের এটি একটি বড়ো অর্জন। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের কারণে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় ৫০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ দ্রুত গতিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মতো সফলতা দেখিয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ ধীরে ধীরে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখি শিল্পায়ন, ১০০ টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক আজ বলে দিচ্ছে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি উদীয়মান শক্তি।
৩০ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেয়া এই বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে আসতে অতিক্রম করতে হয়েছে হাজারো প্রতিবন্ধকতা। পদে পদে মোকাবিলা করতে হয়েছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের পেছন থেকে ছুরি মারার অপচেষ্টা। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরপূর্তি উদযাপনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে সেই আলোচনায় না গিয়েও এটুকু উচ্চারণ না করলে এই নিবন্ধ অসম্পূর্ণ থাকবে। এসব কিছু অতিক্রম করে যুদ্ধবিধ্বস্ত, প্রায় সর্বক্ষেত্রে অবকাঠামোবিহীন সেদিনের সেই সদ্যোজাত জাতির ৫০ বছরের অর্জন আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে হয়তো আরো বেশি হতে পারতো। তবু আমাদের অগ্রযাত্রার পরিসংখ্যান নিতান্ত

অপ্রতুল নয়। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৮টি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা, শিশুমৃত্যু হার কমানো এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের করা মন্তব্য এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তার মতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেবার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের। বিশেষত শিক্ষাসুবিধা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হার এবং জন্মহার কমানো, গরিব মানুষের জন্য শৌচাগার ও স্বাস্থ্যসুবিধা প্রদান এবং শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম অন্যতম।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা অর্জন করেছি নিজস্ব অর্থায়নে বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের সক্ষমতা। পদ্মা সেতুর দৃশ্যমানতা সেই সাহসী পদক্ষেপের গর্বিত সূচনা। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা চট্টগ্রাম চার লেন, বঙ্গবন্ধু টানেল, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ বলে দিচ্ছে বাঙালির মাথা তুলে দাঁড়াবার কথা। এই প্রকল্পগুলো দেশের অগ্রগতির স্মারক হিসেবে বিশ্বের দরবারে নূতন অধ্যায়ের সূচনা করেছে ।
মাথাপিছু আয়, বাজেট বৃদ্ধি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি এসব অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিচায়ক হিসেবে কাজ করে। সরকার কাজ করে যাচ্ছে এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে দেশকে বিশ্ব দরবারে অনন্য উচ্চ মর্যাদায় নিয়ে যাওয়ার। ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সারা বিশ্বের নিকট প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র্যদূরীকরণের ভূমিকা, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে দেশের শিক্ষার হার বেড়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ঝরে পড়ার হার রোধ করা হয়েছে। বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার হার বেড়েছে।
বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ননীতি সংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি) গত ১৫ মার্চ এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটি সূচকের যে কোনো দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উন্নীত হয়েছে।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমরা তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছি অনেক দূর। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতিতে বিশ্ব সম্প্রদায় চমৎকৃত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিতে বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য দেশের ৪৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ পোর্টালের সংখ্যা প্রায় ২৫০০০। দেশের সবক’টি উপজেলাকে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়। কৃষিখাতে অভূতপূর্ব কিছু সাফল্যের জন্য বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ বারবার আলোচিত হয়েছে। প্রায় ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
আমরা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছি ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নের পথে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থানকে আরও দৃঢ়ভাবে গড়ে তোলার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে আরো বহুদূর। বাংলাদেশের পঞ্চাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বান, ‘আসুন দলমতনির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি’।

লেখক : সিনিয়র তথ্য অফিসার, পিআইডি
পি. ফি.

0 Shares