Home » মতামত » বিজয়ের ৫০ বছরের চাওয়া টেকসই উন্নয়নে সরকার ও গণমাধ্যমের পারস্পরিক সহায়তা -পরীক্ষিৎ চৌধুরী

বিজয়ের ৫০ বছরের চাওয়া টেকসই উন্নয়নে সরকার ও গণমাধ্যমের পারস্পরিক সহায়তা -পরীক্ষিৎ চৌধুরী

এবারের ডিসেম্বর অন্যরকম এক ডিসেম্বর। এর আগে ইংরেজি বছরের শেষ এই দিনটি এমনভাবে আর আসেনি। এবারের মতোন এতো আবেগ, এতো প্রাণচাঞ্চল্য, এতো আলোকচ্ছটা নিয়ে ডিসেম্বর আসেনি।
এবার বিজয়ের ৫০ বছর উদযাপন করছে বাংলাদেশ। সঙ্গে চলছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। মুজিব শতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে দৃশ্যমান হলো পদ্মা সেতু, রাজধানীতে পরীক্ষামূলক চললো মেট্রোরেল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে হতদরিদ্ররা পেলো সুসজ্জিত বাড়ি। এই মাহেন্দ্রক্ষণেই সুখবর এলো, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে মধ্যম আয়ের দেশে প্রিয় বাংলাদেশের উন্নীত হওয়ার প্রস্তাব জাতিসংঘে পাস হয়েছে। এখন রূপকল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে এগিয়ে চলেছি ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্র গঠনের অভিযাত্রায়।
এই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সরকারের অন্যতম সহযোগী দেশের গণমাধ্যমগুলো। গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গণতন্ত্রের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও অপরিহার্য। কোনও রাষ্ট্র যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করে, তবে সেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকতেই হবে। গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করতেই পারে। সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও সেই সমালোচিত সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। কারণ সমালোচনার মধ্য দিয়ে সরকারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার কারাগারের রোজনামচায় লিখেছিলেন,‘সত্য খবর বন্ধ হলে অনেক আজগুবি খবর গ্রামে গ্রামে ছড়াইয়া পড়ে, এতে সরকারের অপকার ছাড়া উপকার হয় না’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ৭৯)। মত প্রকাশের পূর্ণ অধিকার এবং সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে তিনি তার বইগুলোতে অসংখ্যবার লিখেছেন এবং সবসময় এ নিয়ে ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। সেই সত্য ভাষণের যথাযথ প্রতিফলনও তিনি দেখিয়েছিলেন ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকালে।
সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে উল্লেখ করা রাষ্ট্রপরিচালনার চারটি মূলনীতির মধ্যে একটি হলো গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণই প্রধান। জনসাধারণের প্রতিক্রিয়াই নির্ধারণ করে দেশটি কীভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করাই গণতন্ত্র। এই মৌলিক আধিকারগুলোর মাঝে মত প্রকাশ ও অবাধ তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতা অন্যতম। বাংলাদেশের সংবিধানের ধারা ৩৯(১)-এ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে এবং ৩৯(২)-এ সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।
তারও অনেক পরে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘রাষ্ট্রে গণমাধ্যম স্বাধীন হলে এমনকি দুর্ভিক্ষও ঠেকিয়ে দেয়া যায়। অজ্ঞতা ও ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি না করে জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞাত হয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারে, সচেতন ভোটাররা তখন খারাপ শাসককে ক্ষমতা থেকে ফেলে দিতে পারে। আবার গণমাধ্যমের সঠিক চর্চা রাষ্ট্র ও জনসাধারণের মাঝে সেতু তৈরি করে। ……যেসব দেশে গণমাধ্যম স্বাধীন, সেসব দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না’। জঁ দ্রেজ ও অমর্ত্য সেন ‘হাঙ্গার অ্যান্ড পাবলিক অ্যাকশন’ (ক্ষুধা ও জনকর্মসূচি) নামের বইটি লিখেছিলেন ১৯৮৯ সালে।
মনে করা হয় জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ১৬ নং সূচকটি। এই সূচকের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান…..টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরি করা। সবার জন্য ন্যায়বিচারের সুযোগ তৈরি করা এবং সর্বস্তরে কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। অর্থাৎ সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে লক্ষ্যমাত্রার অন্যান্য সূচকগুলো অর্জন সম্ভব। এখানেই শক্তিশালী ও স্বাধীন গণমাধ্যমের কার্যকারিতার প্রসঙ্গ অনিবার্য। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সূচক অনুযায়ী সমাজে জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার এবং সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গণমাধ্যমকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতেই হবে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিতকল্পে বর্তমান সরকার পরিচালনাকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে সুষ্ঠুভাবে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। ইশতেহারের ৩.৩০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দলটি যেসব লক্ষ্য ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, গত তিন বছরে তার বেশির ভাগ বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে এবং বাকিগুলোর কাজও প্রক্রিয়াধীন।
জাতির পিতার অনুধাবন ও পদক্ষেপকে মাথায় রেখে তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি এই খাতকে শক্তিশালী করতে বেশ কিছু যুগান্তকারী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছেন। তার সর্বশেষ সংযোজন ডাউনলিংককৃত বিদেশি টিভি চ্যানেলে পণ্যের বাণ্যিজ্যিক প্রচার বন্ধ করা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডিজিটাল কনটেন্ট আপলোডের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধ ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) সার্ভিস সংযোগ উচ্ছেদ স্থানীয় গণমাধ্যমকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখছে।
তারও আগে, পেছনে ফিরে তাকালে, শেখ হাসিনার সরকারের প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) প্রথমবারের মতো বেসরকারি টিভি চ্যানেল (একুশে টিভি) অনুমোদনের মধ্য দিয়ে দেশে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার যুগের সূচনা হয়। পাশাপাশি নৈতিকতা, নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাশীল হয়ে দায়িত্ব পালনের প্রতি গণমাধ্যম কর্মিদেরকেও নিষ্ঠাবান থাকতে হবে।
গণতন্ত্র, সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠায় অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণমাধ্যমের উত্তরোত্তর উৎকর্ষ বৃদ্ধিই গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় সর্বোত্তম সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। সাংবাদিক সমাজ ও সংবাদ মাধ্যমের সমস্যা দূর করে সাংবাদিকতাকে সত্যিকার অর্থে কল্যাণমুখি করতে সরকার দেশের গণমাধ্যমকে সবধরনের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে মতপ্রকাশ ও অবাধ তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রেখেছে। ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই শেখ হাসিনার সরকার ‘তথ্য অধিকার আইন’ প্রণয়ন এবং তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করে। যুগান্তকারী এ উদ্যোগের মাধ্যমে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে গণমাধ্যম কর্মিসহ আপামর জনসাধারণের জন্য চাহিদা অনুযায়ী তথ্য পাবার একটি আইনি সুযোগের দ্বার খুলে যায়। এর ফলে সরকারি-বেসরকারি অফিসসমূহ আইনে বেঁধে দেয়া সময়সীমার মধ্যে সাংবাদিকদের চাহিদা মোতাবেক তথ্য দিতে বাধ্য। ফলে সরকার পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে কার্যকরী পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি অফিসসমূহে তথ্য প্রদানকারী নির্দিষ্ট কর্মকর্তার সংখ্যা ৪২,২৫৪। ২০০৯ সালের জুলাই থেকে গত ১২ বছরে এ আইনের আওতায় সাংবাদিকসহ মোট ১,১৯,৮৩১ ব্যক্তিকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য দেয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তথ্য প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় অনেক কর্মকর্তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে।
সাংবাদিক ও মালিক প্রতিনিধিদের নিয়ে ইতোমধ্যে ৯ম ওয়েজ বোর্ড গঠন করা হয়েছে। সরকার বেসরকারি টিভি চ্যানেলসমূহের সাংবাদিক, ক্যামেরাপার্সন ও অন্য সহযোগী কর্মিদের ওয়েজ বোর্ডে অন্তর্ভুক্তির কথাও ভাবছে। সংশোধিত পেনাল কোডের অধীনে সম্পাদকদের বিরুদ্ধে কোনো মানহানি মামলায় বিজ্ঞ আদালতের সমন ছাড়া শুধু পুলিশি ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করা যায় না। এ ধরনের আইনি সুরক্ষা দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে ভূমিকা রাখছে। সাংবাদিক, লেখক ও ব্লগারদের ওপর অপশক্তির ও জঙ্গিদের হামলার ঘটনায় কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
সরকারের রূপকল্প ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের ফলে আপামর জনসাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে গণমাধ্যম। সারাদেশে বিদ্যুৎ, উচ্চ গতির ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, অসংখ্য টিভি চ্যানেলের সহজলভ্যতা তথ্যকে জনগণের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। পাশাপাশি কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা ও লাইসেন্সিং রেগুলেশন ২০১০, বেসরকারি এফএম বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা নীতিমালা ২০১০, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪, বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট আইন ২০১৪ এবং জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা ২০১৭ (২০২০ সালে সংশোধিত) প্রণয়নসহ প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিনিষেধ প্রণয়ন করে অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
গণমাধ্যমকে আরো গণমুখি করতে জাতীয় অনলাইন নীতিমালা অনুসরণে এ পর্যন্ত ১০৮টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ১৪টি আইপিটিভি, ১৪টি টিভি চ্যানেলের অনলাইন পোর্টাল এবং ১৫৪টি পত্রিকার অনলাইন নিউজ ভার্সনকে অনুমোদন দিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।
সরকারের গণমাধ্যম বান্ধব নীতির সুবাদে সারদেশে বিপুল সংখ্যক পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে মিডিয়াভুক্ত পত্রপত্রিকার সংখ্যা সাতশো’র বেশি। এদের মধ্যে দৈনিক পত্রিকা ৫৬০টি, যার মধ্যে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ২৫৫টি। সরকার এ পর্যন্ত ৪৫টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল, ২৭টি এফএম রেডিও ও ৩১টি কমিউনিটি বেতারকে লাইসেন্স প্রদান করেছে। এর মধ্যে ৩১টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল, ২২টি এফএম রেডিও ও ১৭টি কমিউনিটি বেতারকেন্দ্র বর্তমানে সম্প্রচারে রয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ থেকে ভারতের দূরদর্শন ডিশবিহীন সেদেশে সম্প্রচার করছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর উৎক্ষেপণ দেশের গণমাধ্যম অঙ্গনকে শক্তিশালী করেছে। দেশে টিভি চ্যানেলগুলো এখন অনেক কম খরচে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ব্যবহার করে সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপেণ করা হলে এ সুবিধা আরো বৃদ্ধি পাবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মোবাইল ফোনের ব্যাপক ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যের অবাধ প্রবাহ জোরদার হয়েছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৭ কোটি মোবাইল সিম ও ১১ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা, সমাজের ওপর নতুন ধারার গণমাধ্যম– ‘নিও মিডিয়া’র ব্যাপক প্রভাবের বিষয়টি তুলে ধরছে। অভার দ্য টপ (ওটিটি) মিডিয়া সার্ভিস, ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) সার্ভিস নীতিমালা ও আইপি (ইন্টারনেট প্রোটকল) টিভি/আইপি রেডিও সেবা রেজিস্ট্রেশন নীতিমালা নিয়েও কাজ করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
দেশে ক্রমবর্ধমান গণমাধ্যম অঙ্গনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে আওয়ামী লীগ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পেশাগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সারা দেশে সাংবাদিকদের জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার জন্য দক্ষ জনবল তৈরি করতে ২০১৪ সালে সরকার বাংলাদেশ সিনেমা এবং টেলিভিশন ইনিস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে গণমাধ্যম কর্মিদের প্রশিক্ষণে নিয়োজিত প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ ও জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট-এর সম্প্রসারণ করা হয়েছে। গণমাধ্যমকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে রাজধানীর সার্কিট হাউস রোডে ১০৪ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৬ তলা বিশিষ্ট তথ্য ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। জেলা পর্যায়ে অত্যাধুনিক তথ্য কমপ্লেক্স নির্মাণে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সাংবাদিকদের পেশাগত সহায়তা প্রদানকারী শীর্ষ সরকারি সংস্থা- তথ্য অধিদফতর সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও রংপুর-এ বিভাগীয় অফিস স্থাপন করেছে। এর মাধ্যমে সকল বিভাগে তথ্য অধিদফতরের কার্যক্রম সম্প্রসারিত হলো।
প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া উভয় গণমাধ্যমের সাংবাদিকগণ তাদের নিজেদের কর্মস্থলে চাকুরির অনিশ্চয়তায় ভোগেন, যা স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য হুমকি। তাদের চাকুরির এ অনিশ্চয়তা দূর করতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় প্রণয়ণ করতে যাচ্ছে গণমাধ্যম কর্মি (চাকুরির শর্তাবলি) আইন যা বর্তমানে অনুমোদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সাংবাদিকদের আবাসনের জন্য বিশেষ প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন গণমাধ্যম বান্ধব বর্তমান সরকারের আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সরকারি অনুদানে পরিচালিত এ ট্রাস্ট এর আওতায় ২০১১-১২ সাল থেকে ৫,২৬৩ জন অসচ্ছল সাংবাদিককে ১৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় সময় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি সাংবাদিক পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে মোট ৩ কোটি ৬৬ লাখ ১০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত সাংবাদিকদের জন্য বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টকে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুদান হিসেবে ১০ কোটি টাকা প্রদান করেন, যা বর্তমানে বিতরণ করা হচ্ছে।
তবে অনেক সময় গণমাধ্যমকেও পক্ষপাতিত্ব করতে দেখা যায়। নানান মতাদর্শের ভিন্ন আঙ্গিকের সংবাদ জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা হয়। এর মাধ্যমে গণমাধ্যম অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উৎসাহিত করে। গণমাধ্যমের এ ভূমিকা ক্ষেত্রবিশেষে নিস্প্রভ হয়ে পড়ে হলুদ সাংবাদিকতা, অপসাংবাদিকতার মতো সমস্যার কারণে। গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের সুবিধা নিয়ে সুবিধাবাদীচক্র অসত্য, বিকৃত ও উদেশ্যমূলক তথ্য মুহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে দেখা যায়। আমাদের দেশে নতুন শতকে ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের বিস্ফোরণে অনেক টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেলের আগমন ঘটে। সম্প্রতি ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক মাধ্যমে জনসাধারণ সরাসরি মত প্রকাশ করতে পারছেন। এখন আর মত প্রকাশের স্বাধীনতা শুধু সংবাদপত্রের উপরই নির্ভর করে না। এতে যুক্ত হয়েছে সামাজিক মাধ্যম (ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার) ও ব্লগ। তবে এসব মাধ্যমের সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় অনেক সময় ভুল সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করা হয়, এর ফলে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র বাধাগ্রস্ত হয়। পুঁজিপতি মালিক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রভাবও স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। গণতান্ত্রিক জবাবদিহি ও টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে সংবিধান-স্বীকৃত গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অধিকার সমুন্নত রাখতে সকল প্রকার গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিকদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালনে সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের দায়িত্ব।
শত প্রতিকূলতা ও ঝুঁকি সত্ত্বেও গণমাধ্যম দেশে গণতান্ত্রিক বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অগ্রযাত্রায় সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে অমূল্য অবদান রাখছে। এই ভূমিকা অব্যাহত রাখতে সাংবিধানিক অঙ্গীকার অনুযায়ী গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা ও গণমাধ্যম কর্মিদের নিরাপত্তাসহ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালনের উপযোগী পরিবেশের উত্তরোত্তর বিকাশ নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার সদা সচেষ্ট। গণতান্ত্রিক জবাবদিহি ও সুশাসন সুদৃঢ়তর করতে সরকারের পদক্ষেপ তখনই সার্থকতা পাবে যখন গণমাধ্যমও দায়িত্বশীলতার স্বাক্ষর রাখবে শতভাগ।

-লেখক : সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে তথ্য অধিদফতরে কর্মরত
১৫.১২.২০২১

0 Shares